মেয়ে By: Saleh Tias আমি আজ - TopicsExpress



          

মেয়ে By: Saleh Tias আমি আজ আপনাদের একটা গল্প শোনাতে চাই। জাস্ট একটা গল্প। পুরোটা না শুনে উঠে যাবেন না, প্লিজ। গল্পটা আমার নিজের। হয়তোবা আপনারও। হয়তোবা আপনার আমার মত আরও অনেকের। আমি একটা মেয়ে। অথবা একজন নারী। এই আমার পরিচয়। কি, অবাক হয়ে গেলেন নাকি? ভাবছেন, শুধু ‘নারী’ আবার কেমন পরিচয়? বাপ মা কি কষ্ট করে কোন নামধাম দেয় নাই? আচ্ছা আপনি কি পুরুষ? যদি হয়ে থাকেন তবে বুকে হাত দিয়ে একটু ভেবেচিন্তে বলুন তো, রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেবার সময় রাস্তা দিয়ে একটা মেয়ে হেঁটে গেলে তার দিকে তাকিয়ে জোরে শিষ দিয়ে হেসে উঠতে কি মেয়েটার নাম জানার কোন প্রয়োজন হয়? বা ডিপার্টমেন্টের করিডোর দিয়ে হেঁটে যাবার সময় অচেনা মেয়ের গায়ের উপর ইচ্ছা করে পড়ে যেতে কি মেয়েটার পরিচয় জানার কোন দরকার আছে? গভীর রাতে যখন আপনাদের ঘুম আসে না, কোন হতভাগ্য মেয়ের নাম্বার জোগাড় করে আপনারা যখন ফোনে মিথ্যা কথার বন্যা বইয়ে দেন, তখন কি তার পরিচয় জানার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন হয়? পাষণ্ড পুরুষ বউ পেটাবে, বউয়ের চোখের মধ্যে পৈশাচিক আনন্দে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দেবে, রাস্তায় বা বাসে ভিড়ের মধ্যে ইচ্ছা করে কোন কর্মজীবী মহিলার স্পর্শকাতর অঙ্গ ছুঁয়ে দেবে, কাজের মেয়ের দিকে দেবে লোলুপ দৃষ্টি...ভিকটিম কিন্তু সবসময়ই একজন নারী। কী আসে যায় সে রহিমা, জরিনা বা রুবাবা হলে? কী আসে যায় সে কাজের মেয়ে, গৃহবধূ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলে? আমি এখানে নারী অত্যাচার নিয়ে জটিল কঠিন কোন প্রবন্ধ ফাঁদতে আসিনি। পাঠক মনে করে দেখুন, আমি কিন্তু জাস্ট একটা গল্প বলতে এসেছি। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় আমি মেধাতালিকায় প্রথম ১৭৭ জনের মধ্যে থাকার সুবাদে ঢাকা মেডিকেল কলেজে চান্স পাই। আমাদের ক্লাস শুরু হয় পরের বছর জানুয়ারীতে। আমার ফ্যামিলির অবস্থা ভালো না। আব্বা কী করেন এইটা বলার কোন দরকার আমি মনে করছি না। আমার দুইটা ছোট বোন আছে। একটা কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে, আর একটা একদম পিচ্চি। ছয় বছর বয়স। ইন্টার পরীক্ষা দেবার পর আব্বা এসে বললেন, মা, তোর আর পড়াশোনা করার দরকার নাই। তোরে বিয়া দিয়া দিই। তিনি যা মুখে বললেন না তা হচ্ছে, মা, তোর পড়ার খরচ আমি আর দিতে পারছি না। তোকে বসে বসে খাওয়াতেও আমার কষ্ট হচ্ছে। আমাকে তুই উদ্ধার কর মা। আমি মুখ বন্ধ করে রইলাম। গরীব হলে বেশ কিছু জিনিস অটোমেটিক শেখা হয়ে যায়। নিশ্চুপ ও প্রতিবাদহীন থাকা তার মধ্যে একটি। মেয়ে হলে তো এইসব শেখা আরও সহজ। আব্বাও মুখ বন্ধ করে রইলেন। বড় মেয়েকে যে উনি ভালবাসেন না, তা নয়। কিন্তু এক্সপ্রেস করতে পারেন না। দারিদ্র আর ঐশ্বর্য, দুটোই কি আবেগকে দমিত করে রাখে না? প্রমাণ চান? জলজ্যান্ত প্রমাণ তো আমি, আপনি, সবাই। ঈদে বড় মেয়ে নিজের দেয়া শাড়ি পরে এসে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করুক, এটা কি আমার আব্বা চাইতেন না? দিনের পর দিন একই কাপড়ে নিজের দুহিতাকে দেখতে কি তার খুব ভালো লাগত? যখন গ্রামভর্তি মেয়ে হাতে কানে নাকে যা ইচ্ছা তাই পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, নিজের মেয়ের খালি হাত আর খালি গলা দেখে কি তার হৃদয়ের গোপন কোণে একটা সূক্ষ্ম ব্যথা চিনচিন করে উঠতো না? করত। আমি জানি, আপনি জানেন, করত। হয়ত সেই বুক দুঃখে গোপনে ভেঙ্গেচুরে চুরমার হয়ে যেত। কিন্তু কিছু করার ছিল না। আমি জানি, আপনি জানেন, কিছুই করার ছিল না। যাহোক, আমি ‘বিয়া করতে’ চাইনি। অন্যের ঘাড়ে চেপে বসে আমার পিতাকে উদ্ধার করতে চাইনি আমি। আমি হতে চেয়েছিলাম ডাক্তার। আমার রেজাল্ট ছোটবেলা থেকেই ভালো ছিল। ভালো মানে অতিরিক্ত রকমের ভালো। ঠিক এই কারণে আব্বা আমাকে অসংখ্যবার বলেছেন, মা, তোরে আল্লাহ ভুল কইরা আমার ঘরে পাঠাইসেরে মা... আমি কোচিং করতে পারি নি। কারণ গ্রামে কোন কোচিং ছিল না। শহরের কোচিং এ ভর্তি হতে গেলে আমার দুই বোনের পড়ালেখা তো বটেই, আমার পরিবারের খাওয়াদাওয়াও বন্ধ হয়ে যেত। আমার কলেজের এক স্যার শুধু আমাকে পুরনো একটা ভর্তি গাইড জোগাড় করে দিয়েছিলেন। আর বলেছিলেন, মনে রাখিস মা, পুরো গ্রামের সব মানুষের আশা ভরসা তোর কাঁধে। আমাদের নিরাশ করিস না, মা। আমি তেমন কিছু জানতাম না। চান্স না পেলে আমার পরিবার না খেয়ে মারা যাবে, আমি শুধু এইটুকু জানতাম। আমিই তাদের শেষ ভরসা, আমি শুধু এইটুকু জানতাম। তো যথাসময়ে আমার পরিশ্রমের ফসল মিলল। ডিএমসি তে মিলল চান্স। যাকে আপনারা সোনার হরিণ টরিণ অনেক কিছু বলে থাকেন। ভর্তির আগের দিন ঢাকা এলাম। এমন বাজে জায়গা আমি জীবনেও দেখিনি। আর এত মানুষ! এইটুকু জায়গায় এত মানুষ কীভাবে থাকে তা আমি কোনভাবেই ভেবে বের করতে পারলাম না। আমার সেই স্যারের এক আত্মীয়ের বাসায় রাত কাটালাম আমি আর আব্বা। পরের দিন ডিএমসিতে এলাম আমরা। এসেই আমার আশাভঙ্গ হল। কী নোংরা! এত্ত ছোট! আর ক্যাম্পাসের কোন অস্তিত্বই নেই! আসলে এটা অত নোংরা নয়, কিন্তু দেশের এক নম্বর মেডিকেল হিসেবে আমি আরও অনেক কিছু আশা করেছিলাম। ভর্তির জন্য ছয় হাজার টাকা চাওয়া হল। এত্ত টাকা! আব্বার দেখলাম গলা শুকিয়ে গেছে। হয়তো উনি হাজার মত টাকা নিয়ে এসেছিলেন। সেটা আমাকেই দেবার কথা ছিল। সেই টাকা জোগাড় করতে গিয়ে আবার কিছু বিক্রি টিক্রি করা লেগেছে কী না কে জানে? এই সমস্যার সমাধান করলেন স্যারের সেই আত্মীয়। কেন করলেন কে জানে? টাকা উনি সাথে নিয়েই এসেছিলেন। বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন, এইরকমই ঘটনা ঘটবে। হয়ত স্যার আগেই বলেছেন। কিন্তু স্যারই বা বলবেন কেন? উমম...স্যার অবশ্য অনেকবারই বলেছেন যে উনি আমাকে নিজের মেয়ের মত দেখেন...হয়ত সেই কারণেই। হলে সিট পেয়ে গেলাম। জায়গা হল গণরুমে। বিকালের দিকে আব্বা চলে গেলেন। আমি আগেই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে কাঁদব না। দাঁত চেপে কোনভাবে আমার প্রতিজ্ঞা পালন করলাম। আমাকে দেখে আব্বাও একটু স্বস্তি পেলেন, আমি একটা সিনক্রিয়েট করলে তার প্রচুর সময় নষ্ট হত। বাড়িতে তার বহু কাজ, আমার পিছনে আর কত সময় দেবেন? এর আগে জীবনেও আমি আব্বা-আম্মাকে ছাড়া থাকিনি। হলে প্রথম রাতে ঘুমাতে গিয়ে আমার ঘুমই এল না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। কারও সাথে কথা বললাম না। ভর্তির সময়ও ভালোভাবে কারও সাথে কথা হয়নি। তেমন কাউকেই চিনতাম না আমি। দুই একজন যেচে কথা বলতে এসেছিল, আমার বিষণ্ণ মুখ দেখে ওরাও ফিরে গেছে। পরদিন ওরিয়েন্টেশন হল। তার কিছুদিন পর ক্লাস শুরু হবে। কিন্তু বই তো নেই একটাও। বইয়ের দাম শুনে তো আমার মাথায় হাত। পাঁচ হাজার মত তো লাগবেই। পাঁচ হাজার! এবার আমি কী করব? এবার কার আত্মীয় আমাকে বাঁচাতে আসবে? সেই সমস্যার সমাধান হল এক বড় আপুর পরামর্শে। উনি আমাকে লাইব্রেরি থেকে বই নেবার জন্য বললেন। কিন্তু একজন যে চারটার বেশি বই ইস্যু করতে পারবে না! সে ব্যবস্থাও আপু করলেন। উনি আর উনার ব্যাচের কয়েকজন মিলে আমাকে অনেকগুলো বই ইস্যু করে দিলেন। তাও কিছু বই বাকি থেকে যায়। এবার আপু আমাকে নিয়ে গেলেন অ্যানাটমির একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসরের কাছে। সেই ম্যাডাম আমার ফ্যামিলির অবস্থা টবস্থা শুনে আমাকে ওনার বাসা থেকে কয়েকটা বই এনে দিলেন। আমি কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়লাম। ক্লাসের রুটিন দেখলাম। প্রতিদিন দুইটা লেকচার, দুইটা টিউটোরিয়াল। ডিএমসিতে জীবনের প্রথম লেকচারে গিয়ে দেখি অনেক ছেলেমেয়ে। মেয়েরা বসেছে সামনে, ছেলেরা পিছনে। একটু পরে এক ম্যাডাম ঢুকলেন লেকচার গ্যালারিতে। আমরা উঠে দাঁড়ালাম। তিনি এসে কিছুক্ষণ বকবক করার পর একে একে রোলওয়াইজ সবাইকে দাঁড়িয়ে নিজের নাম আর কলেজের নাম বলতে বললেন। প্রায় সবাই দেখি বড় বড় হাই ফাই কলেজ থেকে এসেছে। আমার টার্ন যখন এল, আমি দাঁড়ালাম। রহিমা বানু, দুধকুমার কলেজ। সবাই দেখি ঘুরে আমার দিকে তাকাল। ম্যাডাম ভ্রূ কুঁচকে বললেন, কী নাম? রহিমা বানু। ম্যাডামকে কনফিউজড দেখাল। বানু? জি, ম্যাডাম। কী কলেজ বললা? দুধকুমার কলেজ। ম্যাডাম চিনতে পারলেন না। বললেন, আচ্ছা, বস। ক্লাস শেষে আমার পাশে যে মেয়েটা বসে ছিল সে জিজ্ঞেস করল, তুমিই তাহলে সেই রহিমা বানু? আমি বুঝতে পারলাম না। সেই রহিমা বানু মানে? মেয়েটা আর কিছু বলল না। আমি ক্লাস থেকে বেরিয়ে করিডোরে এলাম। এই সময় পিছন থেকে একটা ছেলের গলা শোনা গেল, এই তো, এইটাই। আরেকজন বলল, কোনটাই? প্রথম গলাটি বলে উঠল, ঐ যে, বানু। দুধকুমার কলেজের। কলেজের নামের প্রথম অংশে সে অনাবশ্যক একটু বেশি জোর দিল। কিছু গলার সম্মিলিত হাসির শব্দ পাওয়া গেল তারপর। রাগে গা রি রি করে উঠল আমার। আমার এলাকায় হলে ওর গালে এক থাপ্পর মেরে সবকটা দাঁত ফেলে দিতাম। কিন্তু এখানে আমি নিতান্তই সাধারণ এক মেয়ে, এবং জানোয়ার পিশাচ পুরুষরা সবজায়গাই ওঁত পেতে থাকে। আমি না শোনার ভান করে চলে গেলাম। সেইদিন টিউটোরিয়াল হল না। আমি হলে চলে এলাম। প্রথমদিনের ক্লাসের অভিজ্ঞতা ভালো হল না। আমার একগাদা রুমমেটদের কেউ আমার পুরো নাম জানত না। আজকে জানল। আমি রুমে ঢুকলাম। দেখি ওরা মুখ টিপে হাসছে। কী হল? তুমিই সেই বানু, তাই না? দুধকুমার কলেজের? মুখটা শক্ত করে আমি বললাম, হ্যাঁ। কোন সমস্যা আছে? ওরা বোধহয় আমার এরকম রিঅ্যাকশন আশা করে নি। ওরা চুপ মেরে গেল। ওরা হয়ত ধারণা করে বসল, আমি খুবই মেজাজি মেয়ে। আমাকে ঘাটালে হয়তো ফলাফল ভালো হবে না। আস্তে আস্তে আমি ওদের সাথে নিজের আরও কিছু পার্থক্য আবিষ্কার করলাম। যেমন, আমি দুপুরে ঘুমিয়ে আসরের আজানের সময় ঘুম থেকে উঠি। আর ওরা ঘুমায় সারা বিকাল ধরে, ওঠে সাতটা আটটার দিকে। বিকালে সবসময়ই আমি হেঁটে অভ্যস্ত। আমি হাঁটতে গেলে ওদের দু একজনকে সাথে পাই ঠিকই, কিন্তু ওদের স্বভাবটা হচ্ছে চান্স পেলেই পাবলিক প্লেস, যেমন শহীদ মিনার অথবা টিএসসি তে যাওয়া। আমি আবার এত মানুষ জনের মাঝে কেমন অস্বস্তি ফিল করি। তাই আমার ওসব জায়গায় কম যাওয়া হয়। সন্ধ্যায় আমি পড়তে বসি। ওরা বসে আরেকটু পরে। রাতে দু তিনজন মিলে ক্যান্টিনে খাওয়াদাওয়া করি। দশটার দিকে আমার প্রচণ্ড ঘুম আসে। ভয়াবহ ঘুম। বাড়িতে ঘুমাতাম আটটার দিকে। কারণ, কারেন্ট ছিল না। অথচ এখানে অনেক চেষ্টা করেও বারোটা একটার আগে ঘুমাতে পারি না। কারণ, সব লাইট জ্বালানো থাকে, আর মেয়েরা চেঁচামেচি করতেই থাকে অনেক রাত পর্যন্ত। তা সে কারণে হোক আর অকারণে হোক। আমি উঠি অনেক ভোরে। প্রতিদিনই উঠে দেখি সবাই ঘুমাচ্ছে। তা তো ঘুমাবেই, এরা অনেকে যে রাতের ঘুম শুরুই করে রাত তিনটা চারটার দিকে। এতক্ষণ এরা যে কোন বিচিত্র কারণে জেগে থাকে, তা আমার মাথায় ঢোকে না। আমার কোন মোবাইল নেই, আমার সেই স্যারের সেই আত্মীয় মাঝে মাঝে এসে খবর নিয়ে যান। অথচ এইসব মেয়েরা যে কতসব আধুনিক ব্র্যান্ডের মোবাইল ব্যবহার করে তা দেখে আমি পুরো টাশকি খেয়ে গেছি। নামে মোবাইল ফোন, অথচ ক্যামেরা, গান, ভিডিও, গেম - কী নেই তাতে? শুধু তাই নয়, ইন্টারনেটেও ঢোকা যায় সেই তথাকথিত মোবাইল দিয়ে। আর এখানেই হয়েছে সর্বনাশ। মোবাইলে কী এক চ্যাট করা যায়, আর সেই চ্যাট করেও অনেকে রাত পার করে। সবমিলিয়ে, এদের রাতজাগা অভ্যাসটা আমার কাছে পুরো ব্যাখ্যার অযোগ্য লাগে। তবু, আমার খুব একটা খারাপ লাগে না। আস্তে আস্তে সবার সাথে আমার ফ্রেন্ডলি সম্পর্ক তৈরি হয়। অ্যানাটমি ডিসেকশন হল, ফিজিও ল্যাব, কলেজ ক্যান্টিন...সবকিছুকে আমি আস্তে আস্তে ভালবাসতে শুরু করি। কিন্তু, সবসময়ই যা হয়, সমস্যা বাধায় ছেলেরা। এক অথবা একাধিক। পাশ দিয়ে গেলে ওদের যে-ই থাক, একটা না একটা কমেন্ট করবেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যাড কমেন্ট। অথবা অনাবশ্যক জোরে কথা বলবে। অথবা চিৎকার দিয়ে উঠবে। অথবা পথ আটকে দাঁড়িয়ে থাকবে। অথবা গায়ে পরে অনাবশ্যক কথা বলতে আসবে। অথবা কোন ভাবে একটা ধাক্কা খেয়ে মুখটা ইনোসেন্ট করে স্যরি বলবে। আর ওদের সাথে লিফটে উঠলে? ওরে বাপরে! ওদের মুখের কোন বিশ্বাস নেই, কী বলতে কী বলে বসবে, তখন তো আর পালানোরও জায়গা থাকবে না। ছেলেরা অনেক ভাবে ট্রাই করে। কোন মেয়েকে ডিস্টার্ব দিতে চাইলে তারা প্রথমেই সেই মেয়ের ফোন নাম্বার ম্যানেজ করার চেষ্টা করে। ফোন নাম্বার পাওয়ার বেশ কিছু উপায় আছে। হিস্টোলজি রেকর্ড বুক, সন্ধানীর শিট, অ্যানাটমি আইটেম খাতা...এগুলো হচ্ছে কমন অ্যাপ্রোচ। এছাড়াও কোন কোন মেয়ের সাথে কোন একটা ছেলের আগে থেকেই পরিচয় থাকে, বা এক জায়গায় বাসা হতে পারে, বা একই ব্যাচে থাকতে পারে দু জন। সেক্ষেত্রে ছেলেটার কাছে মেয়েটার নাম্বার থাকতেই পারে। আর সেই ছেলের মোবাইল থেকে বা তাকে পটিয়ে মেয়ের নাম্বারটা সহজেই পাওয়া যেতে পারে। আবার মেয়েটার কাছে ডাইরেক্ট নাম্বারও চাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এটা করতে বুকের মাঝে সাহস দরকার, যারা দূর থেকে ইভ টিজিং করেই নিজেকে সালমান খান মনে করে তাদের পক্ষে এটা সম্ভব নয়। যাইহোক, শেষোক্ত পদ্ধতির শিকার হলাম আমি নিজেই। এক মাসে আমার কাছে পাঁচটা ছেলে নাম্বার চাইল। সবাইকে বলতে হল, আমার মোবাইল নেই। এটুকু আর মুখে বললাম না যে বাপের মোবাইল কেনার পয়সা নেই তাই এ অবস্থা। মুখ ব্যাজার করে সবাই চলে গেল। আমি জানতাম যে ওদের দরকার ছিল ‘মেয়ের’ নাম্বার, ‘আমার’ নাম্বার নয়। এদিকে আমার টাকা পয়সা সব ফুরিয়ে গেল। আজীবনের অভাবের মধ্যেই বড় হয়েছি বলে বিপদে ধৈর্য হারালাম না। কয়েকদিন ধার করে চালালাম। এক সময় স্যারের ঐ আত্মীয় এলেন। আমি এই অবস্থার কথা বললাম। উনি কিছুক্ষণ ঠাণ্ডা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, শহীদ মিনারে চল, তোমার সাথে আমার কথা আছে। উনি কী বলতে চান আমি বুঝতে পারলাম না। বললাম, কী বলবেন, ভাইয়া? চল তো আগে। অপরিচিত লোকের সাথে বাইরে যাওয়া আমার এই প্রথম। আমি যেতাম না, নেহায়েত উনি আমার খোঁজ খবর নেন বলে ওনার প্রস্তাবে আমি রাজি হলাম। উনি শহীদ মিনারে বসে যা বললেন, তাতে নিষ্ঠুর লোভী পৃথিবীর পুরনো রূপ নতুন করে প্রস্ফুটিত হল আমার চোখের সামনে। তেমন কিছু না। ওনার একটা বড় ভাই আছে। সে ইন্টার পাশ করে বসে আছে বহুদিন। সে মদ খায়, গাঁজা খায়, হেরোইনও নাকি খায় মাঝে মাঝে, আরও কতকিছু খায় তার কোন হিসাব নেই। সে আগে দুইবার বিয়ে করেছিল, কিন্তু তার গভীর রাতে বাসায় এসে অশ্লীল গালিগালাজ আর দয়ামায়াহীন বউ পেটানোর জন্য কেউই টিকতে পারে নি। আমি যেন তাকে বিয়ে করি। তাকে বিয়ে করলে আমার আর কখনও টাকা পয়সা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। কথাগুলো শুনে আমার কানে হাত দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে আসার কথা ছিল। আর জীবনেও ওনার মুখ না দেখার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নেবার কথা ছিল। কিন্তু আমি তা করলাম না। গরীবদের এত অপমানবোধ থাকলে চলে না। আমি নিশ্চুপ রইলাম। উনি বললেন, আমার ভাইজানকে আমি খুব ভালবাসি জানো...ওনার গলাটা ধরে এল। আমি উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, সেলিম ভাই, আপনার কথা ঠিকই আছে। তবে একটা কথা কি জানেন সেলিম ভাই? টাকা দিয়ে আপনি শরীর পাবেন, কিন্তু আত্মসম্মানবোধটা পাবেন না। এটা এমন একটা জিনিস, যেটা কখনই আপনি কিনতে পারবেন না। কখনই না। আসি। আমি চলে এলাম। আব্বা জানলে কী হবে কে জানে? আব্বা তো এইটাই চায়। আমার বিয়ে হয়ে গেলে তো আব্বার টেনশন অর্ধেক কমে যাবে। তা সে বিয়েটা গরুছাগলের সাথে হলেও আপত্তি নেই। তবে, টাকাওয়ালা গরুছাগল অবশ্যই। কবে যে ডাক্তার হব, আর কবে যে আব্বার টেনশন দূর হবে! আমি একটা টিউশনি খোঁজা শুরু করলাম। কিন্তু ভালো কানেকশন না থাকলে কী আর এসব লাইনে হয়? ব্যাচের এক ছেলে বলল যে তার ছোটবোনকে পড়াতে হবে। তবে কাউকে বলা যাবে না। কী আর করা, রাজি হলাম। তো, একদিন গেলাম। বাসায় কেউ নাই, খালি আমি, ঐ ছেলে আর ওর ছোটবোন। ছাত্রী পুরা হাঁদারাম। কিছুই বোঝে না। হা করে বসে থাকে। মেজাজ খারাপ করে চলে এলাম। পরের দিন খবর পেলাম, আমার পড়ানো নাকি তাদের পছন্দ হয় নি। আমি নাকি বেশি রাফ অ্যান্ড টাফ। আমি নাকি পড়াতে পারি না। আমার নাকি ব্যবহার ভালো না। শুনে খুবই মেজাজ গরম হল। রুমের এক বান্ধবীকে বললাম ঘটনা। সে কথা শুনে চোখ কপালে তুলল। সে নাকি ঐ ছেলেকে পারসোনালি চেনে, ঐ ছেলে নাকি বদের বদ, আর ঐ ছেলের নাকি কোন ছোটবোনই নেই! বুঝলাম, জাস্ট প্রতারিত হয়েছি। প্রতিজ্ঞা করলাম, আর জীবনে কোন ছেলেকে বিশ্বাস করব না। পরে একটা কোচিং সেন্টারে পড়ানোর দায়িত্ব পেলাম। দেখা গেল, আমার প্রতিদিনের বিকালটা সেই ব্যস্ততায় কেটে যাচ্ছে। আবার পড়াশোনাও করতে হচ্ছে পুরোদমে। খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়তাম আমি প্রতিদিন। সন্ধ্যায় আর পড়তে বসতে ইচ্ছা করত না। ঘুমে চোখ ঢুলে আসত। তবুও ‘ডাক্তার হতেই হবে, নাহলে আমার পুরো পরিবার না খেয়ে মারা যাবে’ ভেবে আমি চোখ ঠিকই খুলে রাখতাম। পরেরবার আব্বা যখন এলেন, আমি তখন তার হাতে কিছু টাকা তুলে দিলাম। তিনি তো প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারলেন না কী ঘটছে। পরে টাকা হাতে নিয়ে উনি এত কান্না কাঁদলেন, আমি জীবনেও কাউকে এত কাঁদতে দেখেছি কী না সন্দেহ। আমাকে জড়িয়ে ধরে ‘আমার মা অনেক বড় হবে...’, ‘আমার লক্ষ্মী মা...’, ‘আমার কত ভাগ্য যে তোরে মেয়ে হিসাবে পাইছিলাম...’ এসব কথা শুনে আমিও চোখের পানি আটকাতে পারলাম না। আমিও ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। বারবার বললাম, ‘আব্বা, আপনি গিয়াই ঘরের চাল ঠিক করবেন, আম্মারে একটা ছাগলের বাচ্চা কিন্যা দিবেন, আর পারুলের (আমার মেজ বোন) কলেজের পয়সা দিয়া দিবেন। আমি আপনারে পরের মাসে আরও কিছু টাকা দিতে পারব মনে হয়...’ একসময় একটা বৃত্তির জন্য আবেদন করে পেয়ে গেলাম। তখন মাসে এক্সট্রা আড়াই হাজার টাকা করে পাওয়া শুরু করলাম। ব্যস, আমার দুঃখের দিন বলা চলে কেটে গেল। কিন্তু এখন তো আমার আপনজনের দুঃখমোচনের পালা। ক্লাস শুরু হবার প্রায় পাঁচ মাস পর আমি বাড়িতে গেলাম। সাথে নিলাম আব্বার জন্য লুঙ্গি, আম্মার জন্য শাড়ি, বড়টার জন্য কাঁচের নীল চুড়ি, পুচ্চিটার জন্য ফ্রক। বাড়ি গিয়েই ডাক দিলাম, ‘আব্বা!’ আব্বা বেরিয়ে এলেন। তার চেহারায় কেমন হতচকিত ভাব। ‘তুই? আইসশ? কেমনে আইলি?’ এসব অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন আমার সন্দেহকে বাড়িয়ে তুলল। ‘কিছু হইসে নাকি? আম্মা কই? পারুল কই?’ আব্বা দেখি মাথা নিচু করে ফেলেছেন। কিছু একটা মনে হয় বলতে চান। ‘পারু...ল!’ ‘আম্ম......... া!’ আম্মা বেরিয়ে এলেন। দেখলাম, ওনার চোখে পানি। আমি আব্বার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘কী হইসে আব্বা? বলেন না ক্যান? আব্বা!’ আব্বা পরাজিত মানুষের মত দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর আস্তে আস্তে মাথা তুললেন। ওনার বয়স যেন এক ধাক্কায় দশ বছর বেড়ে গেছে। অচেনা স্বরে বললেন, ‘পারুলের তো বিয়া দিয়া দিসি, মা!’ আমার মাথায় যেন বজ্রপাত হল। মনে হল ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাব। অনেক কষ্টে নিজেকে ঠেকালাম। কোনভাবে বললাম, ‘কীভাবে হইল এইটা?’ আব্বা কান্নাবিজড়িত গলায় বললেন, ‘মা, একখান ভালো সম্বন্ধ আসছিল, পোলা ব্যবসা করে, বাপের অনেক টাকা, ভালো ঘর, আমি আর না করতে পারি নাই, মা!’ ‘আর? পোলারে কী কী দিসেন?’ ‘ওরা বিশ হাজার টাকা আর একটা মোটরসাইকেল চাইসিল’। ‘আর আপনি কী দিসেন?’ ‘আমি কইসি, বাপ, আমার তো অত সামর্থ্য নাই, তবে আমার বড় মাইয়া মেডিকেলে পড়ে, ও আমারে কিসু টাকা দিসে, সামনে মাসে মাসে আরও দিব, আপাতত এইটাই নাও তুমি, পরে মাসে মাসে আমি তোমারে আরও দিমুনে...’ মেজাজটা জ্বলে উঠল আমার। প্রচণ্ড রাগ হল। তবে কার উপর, এটা বুঝতে পারলাম না। আমার বাপের উপর, সেই বরের উপর, দারিদ্রের উপর, নাকি নিজের উপর - কিছুতেই বুঝতে পারলাম না। কিছুই বুঝতে পারলাম না আমি। আমি ঘরে ঢুকলাম। ফুটা চালটা ফুটাই আছে। ব্যাগ রেখে গোয়ালঘরে গেলাম। নাহ, ছাগল নাই কোন। এমনকি আম্মার গরুটাও নাই। সেইটাও যে পারুলের শ্বশুরবাড়িতে ওর টিকিটের দাম হিসেবে ধরা হয়েছে, এ বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ ছিল না। এত দুঃখ কেন মানুষের জীবনে? কেন? কোন উত্তর নেই। সেই ঘরটার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালাম, যে ঘরে আমি আর পারুল জড়াজড়ি করে ঘুমাতাম। কিছু পুরনো দিনের স্মৃতি আমার বর্তমানকে আচ্ছন্ন করে দিল। ‘বুবু, আব্বা বলসে তোমার বিয়া দিয়া দিব’। ‘ধুর পাগলি, আমার বিয়া দিব মানে? তাইলে তোরে কে দেখাশোনা করব?’ ‘এহ! তাই বইলা কি তুমি বিয়া করবা না নাকি?’ ‘ইশ, এইটুকু মাইয়ার কি পাকা পাকা কথা! খালি বিয়ার চিন্তা মাথায় ঘোরে, না?’ ‘তা তো ঘোরেই, তবে আমারটা না, তোমারটা। আইচ্ছা, তুমি নাকি শহরে গিয়া পড়াশোনা করবা?’ ‘হ্যাঁ। ক্যান, তোর কষ্ট হইব নাকি?’ ‘আমার আর কি কষ্ট? আমিও পাশ কইরা তোমার মত শহরে লেখাপড়া করতে যামু। দুই বোন, একলগে পড়াশোনা করমু’। ‘আর তোর বিয়া দিয়া দিলে?’ ‘বিয়া করতে আসুক না, ঠ্যাঙ ভাইঙ্গা ফালামু না!’...স্মৃতির অতল গহবরে হারিয়ে যায় মন। কেন যেন স্রোতের মত অশ্রু নামে চোখ দিয়ে। বোনটা বলেছিল, তার জন্য চুড়ি আনতে। কথা দিয়েছিলাম। আমি তো এনেছিই চুড়ি। কিন্তু তুই কই, পারুল? বোনকে কথা রাখার সুযোগটা পর্যন্ত দিলি না? আম্মা ভাত রান্না করেছিলেন। সাথে কচুশাক। এই জিনিস হলের ক্যান্টিনে ৩ টাকায় অল্পেকটু পাওয়া যায়। ভাত যতই খাও ৭ টাকা। মেয়েরা শাকটাক খেয়ে খেয়ে বোরড হয়ে গেছে। মুরগি খাসি না হলে তাদের চলে না। অথচ, সেই সামান্য কচুশাকই যে মা নামক পরশপাথরের ছোঁয়ায় এমন সুখাদ্য হয়ে ওঠে তা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে? পরের দিন যখন আমি ফিরে আসছি, বাসে বসে অনেক ক্যালকুলেশন করলাম। আব্বা কি কাজটা ঠিক করেছেন? একবার মনে হল, ঠিকই করেছেন। এমনিতেই আমরা গরীব, তারপর আবার যখন পাত্রপক্ষের লোক আসে, তখন আম্মাকে অন্য কোথাও চলে যেতে হয়, কারণ আম্মা কথা বলতে পারেন না। পাত্রপক্ষ মনে করে তাহলে নিশ্চয়ই পাত্রীরও কোন দোষ আছে। এইসব দেখে আর ফুটা চাল দেখে তারা চলে যায়। এখন যখন এমন একটা চান্স পাওয়া গেছে, তখন হাতছাড়া না করে হয়তো আব্বা ঠিকই করেছেন। কিন্তু অবোধ মন কি যুক্তি মানে? কান্নার স্রোতকে কি বেঁধে দেয়া যায় যুক্তির শেকলে? না, যায় না। আমি ফিরে আসি ডিএমসি তে। দেখি, কিছুই বদলায় নি। একজন জিজ্ঞেস করে, এত তাড়াতাড়ি চলে এলি যে? আমি বলি, এইতো তোদের ছেড়ে থাকতে ভালো লাগে না। যেটা মুখে বলি না, বা বলতে পারি না, তা হল, বাড়িতে একদিন বেশি থাকলে যে একটা এক্সট্রা মুখের জন্য দুইবেলা বেশি রান্না করতে হবে। আরও যেটা বলতে পারি না, তা হল, আমার জন্যই বোনটার বিয়ে হয়ে গেল। আমার চান্স পাওয়াটা অ্যাডভারটাইজ না করলে ঐ ছেলে জীবনেও পারুলকে বিয়ে করত না। আমি মাসে মাসে টাকা পাঠাব এ কথা না বললে জীবনেও ওরা আমাদের আঙ্গিনা মাড়াত না। তাহলেই হয়তো বেঁচে যেত আমার বোনটা। ‘আমার আর কি কষ্ট? আমিও পাশ কইরা তোমার মত শহরে লেখাপড়া করতে যামু। দুই বোন, একলগে পড়াশোনা করমু’... হায়, স্বপ্ন কি শুধু বড়লোকদের জন্য? গরিবের ভাগে কি শুধুই দুঃস্বপ্ন? পরের দিন থেকে আমি আবার পুরোদমে পড়াশোনা শুরু করলাম। হাতে যেহেতু কিছু টাকা আমার নিয়মিতই আসছে, ভাবলাম একটা সিম কার্ড কিনি। মোবাইল টোবাইল পরে হবে। কিনলাম একটা সিম কার্ড। রাতে এক ফ্রেন্ড ওর মোবাইলে সিম কার্ডটা ঢুকাল। অন হল সিম। আমার সেই স্যারের নাম্বার ছিল কাছে। ফোন দিতেই ধরলেন। কথা শুনেই চিনতে পারলেন। আমি ওনার সাথে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলাম। এক পর্যায়ে উনি বললেন, ‘সেলিম যায় তো তোমার ওখানে?’ আমি বললাম, ‘জি স্যার’। উনি বললেন, হ্যাঁ, খুব ভালো ছেলে, সমস্যা টমস্যা হলে বলবা। আমি ভাবলাম, সেলিম ভাই হয়তো আসলেই খুব ভালো ছেলে। আমিই হয়তো তাকে চিনতে ভুল করেছি। জি স্যার, বলব। ভালো থেক, মা। ভালো করে পড়াশোনা কোর। রাখি। জি স্যার, স্লামালিকুম। উনি রেখে দিলেন। আমি অনেক চেষ্টা করলাম ফোন নাম্বার গোপন রাখতে, কিন্তু এইসব জিনিস যে কীভাবে ফাঁস হয় খোদাই জানেন। পনেরদিন পর। রাতে আমি আমার সিমটা চালু করেছি। হঠাৎ একটা মেসেজ আসল। Tumi ki amay cheno? ধুত্তেরি, এইগুলা কী? কোথাকার কে পাঠিয়েছে খোদা মালুম। আমার বান্ধবীকে দেখালাম মেসেজটা। বান্ধবী তো মোবাইলটা হাতে নিয়েই এটা কার নাম্বার বের করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অন্য সিম দিয়ে সেই নাম্বারে কল দেয়া হল। দেখা গেল, সেটা বন্ধ। আমি ব্যাপারটাকে পুরা ফাউল প্লে মনে করে স্রেফ ভুলে গেলাম। কিন্তু পরের দিন আবার একটা মেসেজ এল। Phone off thake keno tomar? আরে, আবার শুরু হইসে! মেজাজ খারাপ করে আমি ভাবলাম আগামী সাতদিন সিম আর খুলবো না। সাতদিন পর ঠিকই মেসেজ পেলাম। Ei tumi erokom keno bolo to? এবার আমার হল রাগ। সাথে সাথে ফোন করলাম ঐ নাম্বারে। রিং হল। ওপাশ থেকে কেউ ফোন ধরল। হ্যালো, কে আপনি? উত্তর নেই। হ্যালো, হ্যালো-ও-ও-ও-ও-... সারাশব্দ নেই। আমি রেখে দিলাম। কে হতে পারে এই কালপ্রিট? আমাদের ক্লাসের কোন পোলা? হওয়ার চান্স অত্যন্ত বেশি। এর মাঝে বান্ধবী আমাকে একটা সেট জোগাড় করে দিল। ব্যস, আমার সিম চালু হল অনির্দিষ্টকালের জন্য। অবশেষে আরও সাতদিন পর মেসেজদাতা তার পরিচয় দিল। যা ভেবেছিলাম, তাই। ব্যাচের এক পোলা। আমি তাকে বললাম, তুমি যা করেছ তা হল ইভ টিজিং। ডিসটারব্যান্স। এইসব হল ছোটলোকের কাজ। আমি আশা করি নাই ডিএমসির মত জায়গায়ও এইটা প্রচলিত আছে। তুমি আর কখনও আমাকে ফোন করবা না। মেসেজও দিবা না। এতে কাজ হল। তবে সামান্য। নাম্বারটা যেহেতু ছড়িয়ে গেছে, তাই যেখানেই যাই, সেখানেই মেসেজ আর মিসকল পাওয়া শুরু করলাম। একদিন রিডিং রুমে গেছি, হঠাৎ মেসেজ পেলাম। Tomar dress ta to khub sundor এমন মেজাজ খারাপ হল! আমার ড্রেস সুন্দর, তাতে তোর কী শালার পো? আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে ব্যাচের ছেলেদের খোঁজার চেষ্টা করলাম। বেশ কয়েকজনকে দেখতে পেলাম। বেশ মন দিয়ে পড়াশোনা করার ভান করছে। কিছুতেই অনুমান করতে পারলাম না, এ কাজ কার। মেজাজ খারাপ নিয়ে রিডিং রুম থেকে চলে আসলাম। আসার আগে বেশ জোরেই বললাম, আর জীবনে রিডিং রুমে আসব না। কিন্তু সমস্যা আমার পিছু ছাড়ে না। ব্যাচের কয়েকটা ছেলের সাথে জানাশোনা আছে আমার, তাদের মধ্যে একটার কাজকর্ম যেন কেমন কেমন। মাথায় প্রবলেম আছে মনে হয়। সেই স্ক্রু ঢিলা পোলা একদিন আমাকে মেসেজ দিল। People say that 60 seconds is 1 minute and 60 minutes is 1 hour. But with you, 1 second is more than a hundred years without you, darling. আচ্ছা, দুনিয়ার পোলাগুলা এইরকম কেন? মেয়েদের প্রতি কারও বোধহয় কোন রেসপেক্ট নাই। এইসব আউল ফাউল মেসেজ পাঠায়ে এরা কী মজা পায়? নাকি মেয়েদের ডিস্টার্ব না করলে এদের রাতের ঘুম ভালো হয় না? এদের সবারই কি জেনেটিক প্রবলেম আছে? আমি রিপ্লাই দিলাম, if you ever send these kind of stuff again, our friendship will be gone forever. And I swear, I will slap you and kick the screw out of your head. মেসেজ পাঠিয়ে বেশ শান্তি পেলাম। যাক বাবা, আরেকজনের হাত থেকে তো বাঁচলাম! কিন্তু যারা শুধুমাত্র কুশলাদি জিজ্ঞেস করার উদ্দেশ্যে ফোন দেয় বা আইটেমে কী আছে জানতে চায়, এদের হাত থেকে বাঁচব কীভাবে? এদের সাথে ইচ্ছা না করলেও ভদ্রতা দেখিয়ে কথা বলা প্রয়োজন হয়, হ্যাংলার মত পাশে ঘুরঘুর করলেও গরম দেবার চান্স পাওয়া যায় না। আরও ঝামেলা আছে। ধরুন আমি কোন ছেলের সাথে কথা বলছি, দুই দিন পর আরেক বান্ধবী এসে বলবে, অমুক ছেলে নাকি মন্তব্য করেছে, আমি নাকি এই ছেলের সাথে এনগেজড। বুঝুন অবস্থাটা! আবার কারও সাথে কথা না বললে আরেক ধরণের বিপদ। ‘ওরে, কী ভাব!’ অহরহ শোনার চেয়ে একটু কষ্ট করে দুএকজনের সাথে কথা বলা সহজ। বিপদ আরও এক দিয়ে আসে। সিনিয়র ভাইরা বিয়ের জন্য খোঁজখবর নেন। তাদের অ্যাপ্রোচটাও সাধারণ। প্রথমেই তারা ব্যাচের একটা পরিচিত পোলাকে ধরে বলবে, এই ভাইয়া, শোন, তোমাদের ব্যাচে কোন ভাল মেয়ে আছে?...ইত্যাদি। তারপর সেই পোলা খুঁজে খুঁজে কাউকে বের করবে। সেটা হতে পারি আমি বা আমার বান্ধবী। তারপর আমাদের ফোন নাম্বার জোগাড় করে সেই বড় ভাইকে দেয়া হবে। তারপর... যে বিয়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য আমি এখানে এলাম, যে বিয়ে আমাকে অস্তিত্বহীন করে তুলবে, অনেকেই ধারণা করেন, সেই বিয়ে করার জন্য আমি লাফিয়ে উঠে রাজি হয়ে যাব। হায় পুরুষ! যারা প্রথমে আমার চেহারা দেখে পছন্দ করেন, তারা পরে আমার ফ্যামিলির ব্যাপারে খোঁজখবর নেবার চেষ্টা করেন। এবং খবর নেবার পরই তাদের মুখের এক্সপ্রেশন চেঞ্জ হয়ে যায়। আর হবে নাই বা কেন? আপনি যদি সদ্য ডিএমসি পাশ ডাক্তার হতেন, একজন ফুটো চালের ঘরে বাস করা খেতমজুর আর একজন বোবা মহিলার মেয়েকে কি আপনি বিয়ে করতেন? বলুন, কী হল, পালাচ্ছেন কেন, বলুন না, মেয়ে যতই সুন্দর আর পরিশ্রমী আর বাস্তববাদী আর বুদ্ধিমতী আর হাবিজাবি হোক, করতেন বিয়ে? করতেন?? করতেন??? করতেন না। লজ্জা পাবার কিছু নেই, এটাই বাস্তবতা। করতেন না। ঐ পরিস্থিতিতে কেউ করত না। কিন্তু তবুও যদি সত্যিই কেউ সবকিছু মেনে নিয়ে বিয়ে করতে চাইত আমায়? একান্ত নিজের করে পেতে চাইত আমায়? এবং সে যদি হত এমন কেউ, যে কিনা নিজেই একজন ডাক্তার, বা হবু ডাক্তার, যে আমার কষ্ট বুঝবে, বুঝবে কেন রাত বিরাতে আমাকে বহুদূরে ছুটে যেতে হয় কাউকে বাঁচা মরার লড়াইয়ে জিতিয়ে আসতে, বুঝবে কেন স্বামীসেবা ও শাশুড়িসেবা করার মত যথেষ্ট সময় আমার হাতে থাকে না? সে যদি হত একই সাথে আমার শিক্ষক, আমার ছাত্র, আমার বন্ধু, আমার প্রণয়ী, আমার কলিগ, আমার সহযোদ্ধা? কেমন হত যদি আমরা মহাকালকে ফাঁকি দিয়ে বেঁচে থাকতাম অনন্ত অসীমকাল পর্যন্ত? কেমন হত, বলুন না, কেমন হত? বাংলাদেশে মেয়েদের স্বপ্ন দেখতে নেই। কিন্তু স্বপ্ন যদি না-ই দেখে থাকি, এতটা পথ পাড়ি দিয়ে আমি এতদূর কীভাবে এলাম বলুন? আমি কি স্বপ্ন দেখতে পারি না যে আমার একটা ছোট্ট ফ্যামিলি থাকবে। তার সদস্য হবে চারজন। আমি, সে, আমাদের ছেলে ও আমাদের মেয়ে। আমরা থাকব একটা ছোট্ট বাসায়। বাসার চারপাশে থাকবে অজস্র গাছগাছালি। অজস্র পাখি প্রতিদিন গান গেয়ে আমাদের ঘুম ভাঙ্গাবে। সকালের সোনারঙা রোদের ছটায় আলোকিত হব আমরা। প্রতিদিন ভোরে আমরা হাঁটতে বের হব। আমার কোলে থাকবে ছেলেটা, ওর কোলে মেয়েটা। অবশ্য মেয়েটা আম্মু আম্মু করে কান্নাকাটি শুরু করলে আমরা বাচ্চাদের ইন্টারচেঞ্জ করব। ঠিক যেমন করে এতদিন ইন্টারচেঞ্জ করেছি নিজের মন ও সত্ত্বাকে। সকালে আমরা তাড়াহুড়া করে গুছিয়ে যাব যার যার কাজে। কর্মস্থল থেকে প্রতিদিন অন্তত দু বার হলেও ফোন দিয়ে খোঁজ নিব পরস্পরের। আমি যে ওর পাশে নেই, এ কথা কিছুতেই ওর মনে পড়তে দেব না। বিকাল বা দুপুর বা সন্ধ্যায় বা রাতে ফিরে আসব নীড়ে। বাকি সময়টুকু কেটে যাবে ওর সাথে, আমার সাথে, বাচ্চাদের সাথে, একসাথে। হঠাৎ গভীর রাতে কল আসবে, ম্যাডাম, পানি ভাংসে, শিগগিরি আসুন। এক মুহূর্তে রেডি হয়ে ছুটে যাব আমি। বাচ্চাদের জড়িয়ে ও ঘুমাবে। আমি ক্লান্ত শরীরে ফিরে আসার সাথে সাথে ওর কল আসবে, স্যার, বি-টুর পেশেন্টটা কেমন করছে...আপনাকে যে একটু আসতে হয়... এদিকে হঠাৎ ছেলেটা জেগে উঠে কান্না শুরু করবে। কোথায় অদৃশ্য হয়ে যাবে আমার ক্লান্তি! ওর যাওয়ার পরই বাচ্চাকে নিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করব আমি, ছোটবেলায় মায়ের মুখে শোনা সেই কবিতা, আহারে, তখন মা কত সুন্দর কথা বলতে পারতেন... আব্বার আর দুঃখ থাকবে না, পাকা ঘর হবে, আব্বার নিজের জমি হবে, সেই উর্বর মাটিতে ইচ্ছামত সোনা ফলাতে পারবেন তিনি! আহা, আম্মার চিকিৎসা হবে, আম্মা আবার দুহাত তুলে ডাকবেন, কই রে রহিমা মা আমার! মেজটা লেখাপড়া করে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার টিচার হবে, ওর অশিক্ষিত শ্বশুরবাড়িতে ওকে আর ছোট মনে করবে না কেউ! আহারে, ছোটটা বড় হয়ে সবাইকে বলে বেড়াবে, জানো, আমার বুবু অনে- - -ক বড় ডাক্তার! আহারে! আহারে... স্বপ্নটা যদি সত্যি হত! ********************************************************** রহিমার ডাইরিটা এখানেই শেষ। আমি ওর ক্লাসমেট। নামটা নাইবা জানলেন। ডাইরিটা আমার হাতে কীভাবে এল, তাও নাহয় রহস্যই থাক। ২০১১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি আমি ওকে একটা স্বপ্নের কথা বলেছিলাম। যে আমি আর আরেকজন হাত ধরাধরি করে বাংলার দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা করব। তারপর বলেছিলাম, স্বপ্ন পূরণে তুমি কি আমার সঙ্গী হবে? ওর গাল ঈষৎ রক্তিম হয়েছিল। কিছু না বলে ছুটে চলে গিয়েছিল সে। ১৫ ফেব্রুয়ারি ওর বাবার স্ট্রোক হয়। হাসপাতালে নেবার পর ডাক্তাররা বলেন, ভাস্কুলার মাইক্রোসার্জারি লাগবে, আরও কীসব ওষুধপত্র আছে, পাঁচ লাখ টাকা লাগবে। ১৬ ফেব্রুয়ারি ও সেলিম ভাইয়ের কাছে গিয়ে বলে, আমি আপনার ভাইকে বিয়ে করব। বিয়ে হয়। টাকা পয়সার জোগাড় হয়। অপারেশন হয়। সুস্থ হবার পর ওর আব্বা ওকে দেখতে সেই বাসায় যান। কিন্তু কেউ রহিমাকে খুঁজে পায় না। বাথরুমের দরজা ভেঙ্গে বাথরুমের মেঝেতে শুয়ে থাকা রহিমাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কর্তব্যরত ডাক্তার রহিমাকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত্যুর কারণ হিসেবে তিনি লেখেন, ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা। উনি বোধহয় কালার ব্লাইন্ড, কারণ পেটে পিঠে অসংখ্য মারের দাগ ওনার চোখে পড়ে নি। যে শারীরিক আঘাতের দাগই দেখতে পায় না, সে হৃদয়ের আঘাতের দাগ দেখবে কীভাবে? সুতরাং, মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যাই বটে।
Posted on: Mon, 30 Sep 2013 06:04:48 +0000

Trending Topics



Recently Viewed Topics




© 2015