অধ্যাপক মুনতাসির মামুন - TopicsExpress



          

অধ্যাপক মুনতাসির মামুন সম্প্রতি খুব বিখ্যাত একটি উক্তি করেছেন -- বঙ্গবন্ধু একটি অনিচ্ছুক জাতিকে স্বাধীনতা উপহার দিয়েছিলেন। তেমনিভাবে বলতে গেলে হুমায়ূন আহমেদও একটি গ্রন্থবিমুখ জাতিকে বই উপহার দিয়েছিলেন। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের সিংহভাগই গ্রন্থবিমুখ। এই গ্রন্থবিমুখতার পেছনে লেখকরাও কম দায়ী নন। মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশী লেখকদের কবিতায়-গল্পে-উপন্যাসে সহজবোধ্যতা-সাবলীলতা-জীবনঘনিষ্ঠতা ছিল কম, হুমায়ূন এসে সেই অভাবটি পূরণ করলেন এবং গ্রন্থবিমুখ ক্ষুধার্ত পাঠকদের মন লুফে নিলেন। মধ্যবিত্ত পাঠক খুঁজে পেল ভরসার জায়গা। ছোট-ছোট বাক্য, চিরচেনা চরিত্র, নির্মল হাস্যরস আর দমকা ক্লাইম্যাক্সে-টুইস্টে তিনি পাঠকমনে পাকা স্থান দখল করে নিলেন। এই জামানার পাঠকদের একটা বড় অংশের পাঠ্যপুস্তকের বাইরে পঠিত প্রথম বইটির লেখক তিনি, তার বই পড়েই এই জামানার পাঠকরা পাঠ্যপুস্তকবহির্ভূত পুস্তকের জগতে প্রবেশ করে; ফলে তিনিই এই জামানার বাংলা সাহিত্যের প্রবেশদ্বার। হুমায়ূন আহমেদ বিরাজ করছেন অলরাউন্ডার হয়ে; যে অলরাউন্ডার ব্যাটিংয়ে ব্যর্থ হলে বোলিংয়ে, বোলিংয়ে ব্যর্থ হলে ব্যাটিংয়ে পুষিয়ে দেন। এই বঙ্গভূমে একাধারে অধ্যাপক-ঔপন্যাসিক-গল্পকার-গীতিকার-নাট্যকার-চলচ্চিত্রকারও তার আগে জন্মাননি, একজীবনে বাংলা অ্যাকাডেমি পদক আর একুশে পদকের সাথে জাতীয় চলচ্চিত্রপুরস্কারও আর কেউ পাননি। ফলে -- You can love Humayun Ahmed, you can hate Humayun Ahmed but you cant avoid Humayun Ahmed! তিনি আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে এমনই এক অবিচ্ছেদ্য ফেনোমেনন। তার লেখার স্টাইল অনুকরণের হিড়িক পড়েছে আমাদের এখনকার লেখকদের মধ্যে। ভার্চুয়াল জগতের পরিচিত লেখকদের অনেকেই সজ্ঞানে তাকে অনুকরণ করে থাকেন। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদকে অনুকরণ করে রচিত লেখাগুলোয় যে লাইকগুলো পড়ে, সেই লাইকগুলো পাঠক অবচেতনচিত্তে হুমায়ূন আহমেদকেই দেয়, ঐ লেখককে নয়। হুমায়ূনীয় হ্যাং-ওভার কেটে যাবার পরপরই পাঠকরা ঐ লেখকদের থেকে এক সময়ে মুখ ফিরিয়ে নেবেন, ঐ লেখকরা তখন শূন্য পড়ে থাকবেন সোনার তরির কৃষকের মতো। হুমায়ূন আহমেদ সেই ১০১ বিশিষ্ট নাগরিকের একজন, যাদেরকে নিয়ে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনিই নির্মাণ করেছিলেন শ্যামল ছায়া-আগুনের পরশমণির মতো চলচ্চিত্র, তিনিই লিখেছিলেন জোছনা ও জননীর গল্পের মতো উপন্যাস। আগুনের পরশমণিতে বাঙালি দোকানদার কর্তৃক ইয়াহিয়া খানের ছবিতে থুথু লেপনের দৃশ্যটি বোধহয় গোটা বাংলা চলচ্চিত্রেরই শ্রেষ্ঠ একটি দৃশ্য। তার উদ্ভাবিত তুই রাজাকার সংলাপটি পরবর্তীতে পরিণত হয়েছিল স্লোগানে এবং তার এই কুড়ি বছরের পুরোনো স্লোগানটি পুনর্জীবন লাভ করেছে ২০১৩ সালের শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে এবং শাহবাগ থেকে সারা দেশে। দেশ প্রত্যক্ষ করেছে মাত্র দু শব্দের একটি সংলাপ কতটা ভয়াবহ-বিপজ্জনক-কার্যকর-লক্ষ্যভেদী হতে পারে! ক-তে কাদের মোল্লা -- তুই রাজাকার, তুই রাজাকার স্লোগানটি স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিকে তাড়া করে ফিরবে যাবজ্জীবন। শহিদ পিতার সন্তান হুমায়ূন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নীরবে কাজ করে গেলেও ঐ তুই রাজাকার সংলাপটি ছাড়া রাজাকারবিরোধী তার আর তেমন কোনো সৃষ্টি আমরা পাইনি, বরং শ্যামল ছায়া এবং জোছনা ও জননীর গল্প-সহ বিভিন্ন রচনায় রাজাকারদের প্রতি তার নমনীয় মনোভাব দেখা গেছে এবং দেখা গেছে রাজাকারদের মহত্ত্ব তুলে ধরতে। তার নানা রাজাকার ছিলেন বিধায় এমনটি ঘটেছে। কিন্তু কেবল নানার কারণে গোটা রাজাকারদেরকে নিয়ে তার রচিত ইতিবাচক বাক্যগুলো পরবর্তী প্রজন্মকে ইতিহাস সম্পর্কে ভুল বার্তা দেবে। শেষ-বয়সে দেয়াল উপন্যাসে বঙ্গবন্ধুর খুনিকে নায়কোচিতভাবে উপস্থাপন করেও তিনি ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন, ব্যাপারটি আদালত অবধিও গড়িয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর খুনিকে তার নায়কোচিত চরিত্র প্রদানও ইতিহাসে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে বসতে পারে। ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলোও তিনি তার স্বভাবসুলভ কৌতুকময় ঢঙে লিখে গেছেন। কিন্তু ইতিহাস কৌতুক নয়, ইতিহাসের চরিত্রগুলো ভাঁড় নন; ইতিহাস নিয়ে তিনি কৌতুক না করলেও পারতেন, ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলো তিনি সিরিয়াস ভাষায় লিখলেই পারতেন। একবার এক বালিকা আমাকে বলেছিল হুমায়ূন আহমেদের মুদ্রিত সমস্ত লেখাই তার পড়া, হুমায়ূন আহমেদের নির্মিত সমস্ত নাটক-সিনেমাই তার দেখা। হুমায়ূন আহমেদের দেয়াল উপন্যাস নিয়ে আমি বিতর্কিত একটা স্যাটায়ার লেখায় বালিকাটি আমাকে বলেছিল, হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে কেউ খারাপ কথা বললে তাকে আমি খুন করে ফেলি। পরে আমাকে সে আর খুনটুন করেছে বলে মনে পড়ে না। হুমায়ূন আহমেদ এমনই এক কিলিং স্কয়াড তৈরি করে গেছেন তার সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে। হুমায়ূনমুগ্ধতা আমাদের কাটেনি, এত জলদি কাটার কথাও না। হুমায়ূন এখনও কালের কাঠগড়ায় ওঠেননি। প্রবল হুমায়ূনানুভূতি-সম্পন্ন ঐ কিলিং স্কয়াড তাকে কাঠগড়ায় উঠতে দেয়নি, কিন্তু সময়ই তাকে কাঠগড়ায় তুলবে, সময়ের ছাঁকুনি তার সৃষ্টিগুলো ছেঁকে ছেঁকে পরীক্ষা করবে। হুমায়ূনমুগ্ধ এই প্রজন্মটি অতিক্রান্ত হয়ে গেলে পরের প্রজন্মটি প্রয়াত হুমায়ূনকে কীভাবে গ্রহণ করবে, তাদের ওপর তিনি কতটা প্রভাব ফেলেন বা ফেলতে পারেন, সেটিই দ্রষ্টব্য। ১৯ জুলাই ২০১৩
Posted on: Sat, 19 Jul 2014 06:12:10 +0000

Trending Topics



Recently Viewed Topics




© 2015