আফতাব আহমেদঃ সময়টা ২০০২ - TopicsExpress



          

আফতাব আহমেদঃ সময়টা ২০০২ সাল। অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার ছুড়ে দেয়া ২৫২ রানের টার্গেট মোকাবেলা করতে মাঠে নামে বাঘশিবির। ওপেনিং জুটিতে গোল-গাল চাহনির কাউকে হয়তো সেদিন শ্যাডো করতে-করতে মাঠে নামতে দেখা গিয়েছিল। ওপেনাররা আত্মবিশ্বাস নিয়ে মাঠে নামলেও প্রথম হোঁচট খায় রানের খাতায় অল্প রান তুলেই, মাত্র ৬ রানে। এরপর যেন নাফিস ইকবালের সাথে মাঠের কেন্দ্রে দায়িত্ব নিয়ে ব্যাট চালাচ্ছিল কেউ। অকল্যান্ডের মাটিতে অচেনাই ছিল ছেলেটি। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আবারো বাধার মুখ দেখতে হয় তাকে। ৫১ রানে গুটিয়ে যায় আরো দুটি উইকেট। কোনঠাসা হয়ে পড়ে বাঘশিবির। এমন সময়ে হাসিবুল হকের সাথে আবারো যেন দায়িত্ব নিলো সে। দ্রুত উইকেট চলে যাওয়ায় এবং ভরসাহীন মিডল-অর্ডারের কারণে এই উইকেটটাই ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন শটের দেখা মিলেছিল এই উইকেটটিতে। তবে, এটি পারেনি বাঘশিবিরকে জয়ের প্রান্তে নিতে। স্লো ইনিংস রেট ম্যাচে চাপ খুব বাড়তি যোগান দিচ্ছিল। যেন ফলস্বরূপ, ১৩০ রানে গুটিয়ে যায় আরেকটি উইকেট। হ্যাঁ, ছেলেটি আউট। সেদিন বাংলাদেশ দল জিতেনি। ২৫২ রানের বিপরীতে বাঘেরা সব উইকেট হারিয়ে সংগ্রহ করেছিল ১৪২ রান। যেখানে দায়িত্বশীল ছেলেটা একাই সংগ্রহ করেছিল ১২৩ বলে ৭৯ রান। ফলাফল খারাপ হলেও নির্বাচকেরা যেন একটু সন্তুষ্টি খুঁজে পেয়েছিলেন। সেদিন তাঁদের চোখে পড়েছিল মান বাঁচানো অসাধারণ ইনিংসটি। এরপর ২০০৩ সালে ইংল্যান্ড সিরিজে ডাক পেলেও দলে জায়গা মেলেনি তাঁর। কেননা সে সেদিনের দায়িত্বশীলতা প্রস্তুতি ম্যাচে দেখাতে ব্যর্থ হয়েছিল। যেটির ফলে সমালোচনার মুখে তাঁকে পড়তে হয়। কটুক্তি হিসেবে সংবাদমাধ্যম তাঁকে one-day cowboy সম্বোধন করেছিল। যেটি তাঁর জাতীয় দলে অভিষেকে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। অতঃপর আবারো দক্ষিণ আফ্রিকার মুখোমুখি হতে হলো তাঁকে। সময়টা ২০০৪। এবার জাতীয় দলের হয়ে ওডিআই অভিষেক হতে যাচ্ছে তাঁর। সেদিন বারমিংহামের মাটিতে পলক-এনটিনি-বোয়েরা ছিল খুবই দাপুটে। আর, সেজন্য হয়তো বড়রা গুটিয়ে যায় ৯৩ রানেই। সদ্য অভিষেক হওয়া ছেলেটিও সেদিন ব্যর্থ! সেদিন সে ব্যক্তিগত রানের খাতায় কোনো রানই তুলতে পারেনি। টেস্ট অভিষেকটা ঘটল একই বছরেই, ঠিক পরের মাসে। ২০০৪ সালে নিউজিল্যান্ড সিরিজের প্রথম টেস্টে হান্নান সরকারের টানা দুই ইনিংসের ব্যর্থতা তরুণ ছেলেটিকে জায়গা করে দেয় ক্রিকেটের সবচেয়ে মূল্যবান সংস্করণে খেলবার। দ্বিতীয় টেস্টটি হয়েছিল ছেলেটির আপন এলাকা চট্টগ্রামেই। বাংলাদেশ দল সেই ম্যাচে ইনিংস পরাজয়র মুখ দেখেছিল। ফ্লেমিংয়ের দানবীয় ইনিংস ম্যাচটাকেই বদলে দিয়েছিল। ছেলেটি তার প্রথম ইনিংসে ব্যক্তিগত রানের খাতায় সংগ্রহ করলো ২০ এবং ২৮ রান। এভাবে সফলতার মুখ না দেখাটা যেন তাঁর মাঝে জেদ চাপাচ্ছিল ভালো করবার। ২০০৫ সালের ইংল্যান্ড সফরে টেস্টের জন্য দলে আবারো সে জায়গা পায়। বাংলাদেশ দল আবারো ইনিংস পরাজয়ের মুখ দেখল এবং ছেলেটি দুই ইনিংসে সংগ্রহ করল ২০ এবং ৩২ রান। লর্ডস টেস্টের ব্যর্থতা যেন ঘুচানো যায়, শক্তিশালী ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ভাল খেলবার মানসিকতা নিয়ে দ্বিতীয় টেস্ট শুরু করে বাংলাদেশ দল। কিন্তু আবারো ব্যর্থতা। ১০৪ রানে গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ। ইংল্যান্ড তাঁদের প্রথম ইনিংসে লিড নিল ৩৪৩ রান। টেস্টে বাংলাদেশের অমন করুণ সময়ে ইনিংস পরাজয় রুখবার জন্যই যেন নড়েচড়ে বসলো দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাটসম্যানেরা। জাভেদ ওমর বেলিমের ৭১ এবং হাবিবুল বাশারের দ্রুত ৬৩ রানের ইনিংসের উপর হয়তো পুরো দল সেদিন ভরসা খুঁজে পাচ্ছিল। কিন্তু তাঁদের প্রস্থান আবারো ভাবিয়ে তুলে দলকে। এমন সময় চেস্টার-লি-স্ট্রিটের মাটিতে মিডল-অর্ডারের দায়িত্ব নেয় সেই ছেলেটি। ১৩টি চার এবং একটি ছক্কায় সাজিয়ে তুলে ক্যারিয়ার সেরা ৮২ রানের ইনিংসটি। সেদিনের দ্বিতীয় ইনিংসের একমাত্র নট-আউট ব্যাটসম্যান ছিল সে। বাংলাদেশ ইনিংস পরাজয়ের মুখ দেখল মাত্র ২৭ রানের জন্য। কিন্তু আবারো খুঁজে পেলো দায়িত্বশীল কাউকে। এই গেলো ব্যাটিং এর শুরুটা। বোলিং-এ ছিল তাঁর বিচক্ষণতা। কাটার ডেলিভারী ছিল তাঁর হাতিয়ার। স্লো মিডিয়াম বোলিং-এ ডেলিভারীটা খুবই কার্যকরী ভূমিকা রাখতো। রাইট আর্ম মিডিয়াম বোলিং করে দলে নতুনত্ব এনেছিল ছেলেটি। ২০০৪ সালে তখনকার নিউজিল্যান্ড দলের বিপক্ষে তুলে নিয়েছিল ৫ উইকেট মাত্র ৩১ রানের বিনিময়ে। যা তাঁর ওডিআই ক্যারিয়ারে সেরা বোলিং ফিগার। শক্তিশালী নিউজিল্যান্ড দলকে হকচকিয়ে দেয়ার মতো ছিল সেদিনের এই তরুণ বোলার। ফিরে আসি আবারো তাঁর ব্যাটিং-এ। অনসাইডে ব্যাট চালানোতে সে খুব দক্ষ ছিল। প্রিয় শটও ছিল পুল এবং সুইপ। ইনিংসে অন্তত একটি ছক্কা যেন তাঁর তৃষ্ণা বাড়িয়ে তুলতো। এজন্য, মিডল-অর্ডারে হিটিং-এ সে ছিল ভরসার পাত্র। যদিও ২০০৫-এ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৩-২ ব্যবধানে সিরিজ জয়ের জন্য, পঞ্চম ম্যাচে টপ অর্ডারে ৮১ রানের অসাধারণ ইনিংস খেলে দলকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল জয়ের প্রান্তে। ২০০৫-এ বাংলাদেশ ক্রিকেট বিশ্বের তৎকালীন সবচেয়ে শক্তিধর দল অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে সক্ষম হয়েছিল। আশরাফুলের স্মরণীয় ইনিংসের কল্যাণে জয়টা সহজ হয়েছিল। দ্বিতীয় ইনিংসে খেলতে নামা বাঘদের সুখকর ইনিংসের ইতি টেনেছিল মিডল অর্ডারের এই ছেলেটিই, দায়িত্বের সাথে। ম্যাচ রিপোর্টে লেখা হয়েছিল এরকম, The coup de grace, however, was delivered by him. With seven needed for victory, it had all come down to the final over, delivered by Jason Gillespie. One blow put the contest beyond doubt - a mighty smear sailed clean over midwicket for six, to cue the most crazy scenes of jubilation ever witnessed at Sophia Gardens. Bangladesh had earned the respect of the cricketing world, and Australias aura of invincibility was shattered. গিলেস্পি সেদিন ভ্যাবাচ্যাকাই খেয়ে গিয়েছিলেন এরকম ছক্কায়। আর, অধিনায়ক রিকি পন্টিং যেন নির্বাক। সেদিন ক্রিকেটবিশ্বের কাছ থেকে বহু প্রশংসা কুড়ায় বাংলাদেশ দল। ছেলেটির ওডিআইতে ক্যারিয়ার ইনিংসটা এসেছিল ২০০৭ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। ৯২ রানের অসাধারণ ইনিংসটি ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি থেকে দূরে রাখলেও সেদিনের ম্যাচসেরার পুরস্কার নিশ্চিত করেছিল। মারকুটে ব্যাটিং-এর কারণে টি-টুয়েন্টি দলে সে ছিল ভরসার পাত্র। আর তাই, ২০০৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জয়ের পিছে তাঁর অবদান ছিল ক্যারিয়ার সেরা ৬২ রানের ইনিংস। যা এসেছিল ৪৯ বল খরচের বিনিময়ে। এই ইনিংসের কল্যাণে সেদিনের ম্যাচসেরা আশরাফুলের ইনিংস ম্যাচ জেতাতে ভূমিকা রেখেছিল। বাংলাদেশ দল এগিয়ে গিয়েছিল টিটুয়েন্টি বিশ্বকাপে দ্বিতীয় পর্বে খেলবার লক্ষ্য অর্জনে। ফিল্ডিং-এ সে খুবই দক্ষ ছিল। অধিনায়ক শর্ট অঞ্চলে তাঁকে আস্থাশীল মনে করতেন। দায়িত্বের সাথে ফিল্ডিং করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার ইঞ্জুরির মুখোমুখি হতে গিয়েও সে রক্ষা পেয়েছিল। দূর্দান্ত ডাইভ, দ্রুত মুভমেন্ট সারাক্ষণই ব্যাটসম্যানের জন্য হুমকি ছিল। ওদের তখন পল কলিংউড ছিল, এন্ড্রু সায়মন্ডস ছিল। আমাদের ছিল এই ছেলেটি। খুব ভাল লাগতো তখন নড়বড়ে বাংলাদেশ দলে একজন সাহসী হার্ড-হিটার ব্যাটসম্যানকে দেখতে পেয়ে। মিডিয়াম পেস বোলিং-এ পারদর্শী অল-রাউন্ডারের যেখানে হাহাকার, সেখানে ঘাটতি পূরণ করেছিল এই ছেলেটি। টপ অর্ডারের ব্যর্থতার পরও দর্শকদের মাঝে উত্তেজনা থাকতো মিডল অর্ডারে তাঁর মারকুটে ব্যাটিং দেখবার। ব্রেক-থ্রু আনাতে সে ছিল বেশ কার্যকরী। উইকেট উদযাপন এবং জয় উদযাপনে দলকে মাতিয়ে রাখতে সে ছিল খুবই স্বতঃস্ফূর্ত। সে চট্টগ্রামের ছেলে, আফতাব আহমেদ। দায়িত্বহীনতার কারণে বেশ কয়েকবার সমালোচনার মুখোমুখিতে পড়তে হলেও, নড়বড়ে দলের হয়ে দায়িত্বেরও পরিচয় দিয়েছে এই আফতাব। ওডিআইতে বেশ কয়েকটি (১৪টি) হাফ-সেঞ্চুরী এর প্রমাণ। বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রত্যেকটি কনিষ্ঠ স্তরে সে খেলেছে। যেমন, ২০০২ সালের অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ। কিন্তু অবহেলার শিকার, সুযোগের অভাব ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের পোড়া রূপ। যা তাঁর ক্যারিয়ার রঙিন হতে দেয়নি। এছাড়াও ২০১০ সালে নিষিদ্ধ ক্রিকেট লিগ ICL-এ খেলতে গিয়ে সে সমালোচনার মুখে পরে আবারো। যে কারণে বোর্ড থেকে শাস্তিও পেতে হয়। সত্যি খারাপ লাগছে তাঁর অবসরের খবরটি। বাধ্য হয়েই হয়তো সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাতীয় দলে তাঁর আর খেলোয়াড় হিসেবে ভূমিকা থাকবে না। তবে চাইব, অভিজ্ঞতা দিয়ে যেন দলের নতুনদের অনুপ্রাণিত করুক। দলে এখনো মিডল-অর্ডারে একজন হার্ডহিটার ব্যাটসম্যান প্রয়োজন। মিডিয়াম পেস বোলিং করতে পারে তাঁর মত এরকম কার্যকরী অল-রাউন্ডারের মুখ দেখেনি বাংলাদেশ দল। দুআ করি তাঁর সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য। এক নজরে আফতাব আহমেদঃ জন্মঃ ১০ নভেম্বর, ১৯৮৫ ডান-হাতি ব্যাটসম্যান, ডান-হাতি মিডিয়াম বোলার টেস্ট অভিষেকঃ বাংলাদেশ বনাম নিউজিল্যান্ড, চট্টগ্রাম, অক্টোবর ২৬-২৯ ২০০৪ ওডিআই অভিষেকঃ বাংলাদেশ বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা, বার্মিংহাম, সেপ্টেম্বর ১২ ২০০৪ টি-টুয়েন্টি অভিষেকঃ বাংলাদেশ বনাম জিম্বাবুয়ে, খুলনা, নভেম্বর ২৮ ২০০৬ ব্যাটিং ও ফিল্ডিংঃ টেস্টঃ ম্যাচঃ ১৬, ইনিংসঃ ৩১, সেরাঃ ৮২*(বনাম ইংল্যান্ড), গড় ২০.৭৮, স্ট্রাইক রেট ৪৯.৬১, সেঞ্চুরী ০, হাফ-সেঞ্চুরী ১, ৪ ৭৮টি, ৬ ৩টি এবং ক্যাচ ৭টি। ওডিআইঃ ম্যাচঃ ৮৫, ইনিংসঃ ৮৫, সেরাঃ ৯২(বনাম জিম্বাবুয়ে), গড় ২৪.৭৩, স্ট্রাইক রেট ৮৩.০৪, সেঞ্চুরী ০, হাফ-সেঞ্চুরী ১৪, ৪ ২০৫টি, ৬ ৪৯টি এবং ক্যাচ ২৯টি। টিটুয়েন্টিঃ ম্যাচঃ ১১, ইনিংসঃ ১১, সেরাঃ ৬২(বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ), গড় ২২.৮০, স্ট্রাইক রেট ১২৮.০৮, সেঞ্চুরী ০, হাফ-সেঞ্চুরী ১, ৪ ২৬টি, ৬ ৬টি এবং ক্যাচ ৪টি। বোলিংঃ টেস্টঃ ম্যাচঃ ১৬, ইনিংসঃ ৯, বলঃ ৩৪৪টি, রানঃ ২৩৭, উইকেটঃ ৫টি, সেরাঃ ২-৩১, গড়ঃ ৪৭.৪০, ইকোনমিঃ ৪.১৩ ওডিআইঃ ম্যাচঃ ৮৫, ইনিংসঃ ৩০, বলঃ ৭৩৯টি, রানঃ ৬৫৬, উইকেটঃ ১২টি, সেরাঃ ৫-৩১, গড়ঃ ৫৪.৬৬, ইকোনমিঃ ৫.৩২ টিটুয়েন্টিঃ ম্যাচঃ ১১, ইনিংসঃ ১, বলঃ ২টি, রানঃ ৮, উইকেটঃ ০টি, সেরাঃ - , গড়ঃ ২৪.০০, ইকোনমিঃ - **তথ্য ক্রিকইনফো থেকে সংগৃহীত।
Posted on: Sat, 30 Aug 2014 06:05:13 +0000

Trending Topics



Recently Viewed Topics




© 2015