গাজার - TopicsExpress



          

গাজার দুঃখগাঁথা ------------- পর্বঃ ৫ (শেষ পর্ব) -------------- গাজায় চলমান অবরোধের কারণে সেখানকার অধিবাসীদের মানবেতর জীবন যাপন করার কথা বলছিলাম। Save The Children এর ২০১২ এর রিপোর্ট অনুযায়ী গাজায় সবচেয়ে নিগৃহীত ও মানবেতর জীবন যাপন করছে শিশুরা। বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাবে পানিবাহিত রোগগুলো মহামারী আকারে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমাগত অপুষ্টিতে ভোগার কারণে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কার্যকরভাবে গড়ে ওঠে না। প্রায় ৮৭ শতাংশ শিশু মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। রাতের অন্ধকার নেমে এলেই তারা চিত্কার করে কান্না শুরু করে ভয়ে। একই রিপোর্টে জানা যায়, গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট মূল অফিস এবং হাসপাতালগুলো পূর্ব জেরুজালেমে অবস্থিত। সংকটাপন্ন রোগীদের সেই হাসপাতালগুলোতে নিয়ে যেতেও ইসরায়েলিদের অনুমতি লাগে। ২০১১ সালের হিসাব অনুযায়ী প্রতি ২০ জন শিশুর মধ্যে ১ জনকে চিকিত্সক উন্নত চিকিত্সার জন্য জেরুজালেমের হাসপাতালে ট্রান্সফার করে। কিন্তু অধিকাংশ সময়েই অনুমতি মেলে না তাঁদের! World Health Organization (WHO) এর সুত্রে জানা যায় ২০১২ সালে ইসরায়েল প্রায় ১২,০০০ গাজাবাসী রোগীর উন্নত চিকিত্সার জন্য পূর্ব জেরুজালেম কিংবা অন্য শহরে পাঠানোর আবেদন নাকচ করে দিয়েছে। একই সময়ে তাঁদের মধ্যের ৬১৮ জন গাজাবাসীকে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে নিয়ে অত্যাচার করেছে! Euro-Mediterranean Human Rights Network সহ পৃথিবীর বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন গাজাবাসীর জন্য টনের পর টন জরুরি ঔষধ ও খাদ্য সাহায্য নিয়ে গিয়ে ইসরায়েলি বাধার মুখে ফিরে এসেছে। তাঁরা এক যৌথ বিবৃতে পরিষ্কার করে বলেছে - ইসরায়েল গাজা অবরোধ করে গাজাবাসীকে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্থ করতে চায়। পাঠককুল, শুনলে অবাক হবেন - গাজাবাসীর জন্য ইসরায়েলি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আলাদা ডাক্তার-বৈজ্ঞানিক রয়েছেন যাদের কাজ হলো - গাজায় প্রতিদিন মাথা পিছু কত গ্রাম খাদ্য সরবরাহ করলে গাজাবাসী মরবে না, কিন্তু ধীরে ধীরে দীর্ঘমেয়াদী রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়বে - এই তথ্য গবেষনার মাধ্যমে খুঁজে বের করা! ইসরায়েলের নৈতিকতা বিবর্জিত মানুষ হত্যা কার্যক্রম এবং ফাতাহ সমর্থিত ফিলিস্তিনি সরকারের দুর্নীতি এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে বার বার ব্যর্থতা মূলতঃ তুলনামূলকভাবে নবীন সংগঠন হামাসকে গাজাবাসীর কাছে দিন দিন জনপ্রিয় করে তুলেছে। হামাস এর প্রতি রয়েছে ফিলিস্তিনিদের (গাজা এবং পশ্চিম তীর) ব্যাপক সমর্থন। কারণ হামাস কট্রর ইসরায়েল বিরোধী এবং একই সঙ্গে জনহিতকর ও সামাজিক কর্মসূচির জন্যও হামাস ফিলিস্তিনিদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। ইসরায়েলি বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় উঠে এসেছে, হামাসের কার্যক্রমের ৯০% হলো সামাজিক, শিক্ষা বিস্তার, সংস্কৃতি ও জনকল্যাণমূলক কাজ। এই সামাজিক কাজের মধ্যে দাতব্য চিকিত্সা, মসজিদ স্থাপন, স্কুল ও শিশুশিক্ষা অর্থায়ন, খেলাধূলার জন্য ক্লাব প্রতিষ্ঠা অন্যতম। শত অবরোধের মধ্যেও বার্ষিক ৭০-৯০ মিলিয়ন ডলারের একটি বাজেট দিতে সক্ষম হয় হামাস। এই অর্থের প্রায় ৮৫% অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয় সামাজিক ও জনকল্যাণমূলক কাজে। প্রতিরক্ষা এবং সামরিক খাতে বরাদ্দ যায় বাকি ১৫%। সংগঠন হিসেবে হামাস মূলত তিনটি শাখার সমষ্টি - রাজনৈতিক শাখা, সমাজকল্যাণমূলক শাখা এবং সামরিক শাখা। মজলিশে শূরা হামাসের প্রতিনিধিদের মিলনস্থল, যার মাধ্যমে হামাস সমগ্র ফিলিস্তিনে তার কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। তবে হামাসের নীতিনির্ধারণী পরিষদ হলো পনেরো সদস্যের “পলিটিক্যাল ব্যুরো”। বর্তমানে হামাসের প্রধাণ হলেন খালেদ মিশাল; আর গাজা অঞ্চলে প্রধাণমন্ত্রী হিসেবে রয়েছেন ডঃ ইসমাইল হানিয়া। হামাসকে সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত করা হয় তার সামরিক শাখা ইজ্জদ্দিন আল ক্কাসাম ব্রিগেডের কার্যকলাপের মাধ্যমে, যাকে সংক্ষেপে আল ক্কাসাম ব্রিগেড বলা হয়। এটি ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং তখন থেকেই ইসরায়েলকে সামরিকভাবে তটস্থ করে রেখেছে তারা। সীমিত সাধ্যের মধ্যেও দেশী প্রযুক্তি দিয়ে ক্কাসাম রকেট দিয়েই আমেরিকার অর্থায়নে তৈরী আয়রন ডোম অ্যান্টিমিসাইল সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ করেছে হামাস। শত্রুর মিসাইল এবং এফ-১৬ এর মোকাবেলায় হামাসের ব্যবহার করা অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে অল্প পাল্লার আল-বানা, আল-বাতার এবং আল-ইয়াসিন রকেট। এছাড়াও এই ব্রিগেডের কিছু ট্যাংক বিধ্বংসী গোলাসহ কিছু হালকা যুদ্ধাস্ত্রও রয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় যেই অস্ত্র রয়েছে তাঁদের, তার নাম - সাহস এবং মহান আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা। কিছুদিন আগে ভূমধ্যসাগরের তলদেশ দিয়ে ইসরায়েলে পৌছে এক দুঃসাহসিক কমান্ডো অভিযানের চেষ্টা চালায় হামাস যোদ্ধারা। তাঁরা জানত - এই অপারেশনে সফল হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত নগন্য। তারপরেও পরাজয় নিশ্চিত জেনেও সংশপ্তক এর মতো এগিয়ে গিয়েছে তাঁরা ও শহীদ হয়েছে। ইরানের পর মুসলিম দেশ হিসেবে সাফল্যজনকভাবে ড্রোন তৈরি করতেও সক্ষম হয়েছে হামাস, যা তেলাবিবের আকাশ পর্যন্ত পৌছে গিয়েছে। তবে হামাস যোদ্ধারা গ্রাউন্ড কমব্যাটে যথেষ্ট প্রশিক্ষিত। এই কারণেই ৩০ দিনেরও বেশি সময় নিয়ে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আর প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী দিয়ে ৩৬০ বর্গ কিলোমিটারের এই শহরকে এখনো হার মানাতে পারে নি ইসরায়েল। হামাস নেতা খালিদ মিশাল যখন জর্ডানের হামাসের শাখা প্রধান হিসেবে কার্যরত ছিলেন, তখন তাঁকে হত্যার একাধিক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলো ইসরায়েলী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এবং সিনবেথ। তবে হামাসের যোদ্ধাদের সাহস এবং দৃঢ়তায় তারা সফল হতে পারে নি। বরং মোসাদের দুইজন গুপ্তচরকে তারা ধরে ফেলে। পরবর্তিতে জর্ডানের বাদশাহ হোসেনের হস্তক্ষেপে বন্দী বিনিময় সেই দুইজন গুপ্তচরের বিপরীতে হামাস তার প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইসমাইল হাসান ইয়াসিন (রাহিমাহুমুল্লাহ) কে ইসরাযেল এর কারাগার থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসে। একইরকমভাবে গিলাদ শালিত নামে এক ইসরায়েলি সেনার বিপরীতে গত ২০১১ সালে হামাস ১০৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্ত করেছে! ইসরায়েলের কারাগারে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি এখনো মানবেতর জীবন যাপন করছে। এমন অনেকেই আছেন যাদের শিশুকালে ইসরায়েল ধরে নিয়ে গেছে আর কারাগারেই বাকি জীবনটা পার করে দিয়েছেন। হামাস এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে চোরাগুপ্তা হামলা চালিয়ে ইসরায়েলকে সবসময় তটস্থ রাখা এবং ইসরায়েলকে গাজা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করা। সময়ের বিবর্তনে এখন হামাস শুধু গাজাবাসীদের হৃদয়ে নয় বরং পশিম তীর সহ সারা বিশ্বের মজলুম সংগ্রামী মানুষের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। Pew Research Center এর সাম্প্রতিক একটি জনমত জরিপে দেখা গেছে, পশ্চিম তীরের ফাতাহ সমর্থিত এলাকায় ৫২% মানুষ তাদের সমর্থন জানিয়েছে হামাসের পক্ষে, অপরদিকে ফাতাহ’র জনসমর্থন মাত্র ১৩%। জর্ডানের প্রায় ৬৩% মুসলিম এবং লেবানন ও মিসরের প্রায় ৫৮% মানুষ হামাসের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছে। ফাতাহ সমর্থিত ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এখন পরিষ্কার বুঝতে পারছেন যে পশ্চিম তীর ও গাজার মানুষজন খুব শীঘ্রই যৌথভাবে হামাসের প্রতি আস্থা রাখতে শুরু করবে। এই ভয় অবশ্য ফাতাহ নেতাদের অনেকদিন থেকেই ছিল। ২০১০ সালের নভেম্বর, ২০১১ সালের মাঝামাঝি এবং ২০১২ সালের এপ্রিলে মাহমুদ আব্বাস হামাস এর সাথে অভিন্ন সার্থে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। গাজা ছাড়া ফিলিস্তিনের আরেকটি ভুখন্ড হচ্ছে পশ্চিম তীর যেটি ফাতাহ এর মূল ঘাঁটি। ২০১৪ সালের ৪ জুলাই শুরু হওয়া Operation Protective Edge এর বিরুদ্ধে এবং গাজাবাসীর মূল দাবি অবরোধ তুলে নেয়ার বিষয়ে ইতিমধ্যেই পশ্চিম তীরের মানুষজন আকুন্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন। এই পর্যন্ত ৩ বার তাঁরা গাজা ও জেরুজালেমের উদ্দেশ্যে লং মার্চ করেছিল। প্রতিবার-ই শহরের বাহিরে আটকে দেয়া হয়েছে তাঁদের। গতকাল পর্যন্ত পশ্চিম তীরের বিক্ষোভে ইসরায়েলি হামলায় ২১ জন শহীদ হয়েছে। একই সাথে পশ্চিম তীর বাসী ফাতাহর নেতৃস্থানীয় লোকজনদের প্রকাশ্যে ব্যর্থ নেতা হিসেবে সমালোচনা করছে। গাজায় ৩ দিনের অস্ত্রবিরতির ২য় দিন চলছে। মিশরের কায়রোতে ফিলিস্তিনি (ফাতাহ ও হামাস) এবং ইসরায়েলি মুখপাত্ররা আলোচনা করে কোন স্থায়ী সিদ্ধান্তে আসতে চাচ্ছেন। আলহামদুলিল্লাহ, এখন পর্যন্ত আরব সহ বিভিন্ন মহলের প্রবল চাপ স্বত্বেও হামাস তাঁদের দাবির বিষয়ে অনড়। হামাস তথা গাজাবাসীর মূল বক্তব্য - অবরোধ তুলে একজন সাধারণ মানুষের মতো বাঁচতে দিন আমাদের। সেটি না হলে কুকুর-বিড়ালের মতো যেভাবে রকেট-মর্টার চালিয়ে মারছিলেন আমাদের, সেভাবে মেরে ফেলুন। বেঁচে থাকতে হলে মানুষের মতো বাঁচবো, মরতে হলে শহীদের মতো মরব। গাজাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও জনবহুল উন্মুক্ত কারাগার বলেন অনেকে। আমরা (গাজাবাসী) বলি, গাজা তার থেকেও খারাপ। কারাগারে তো মানুষ নিতান্ত তিন বেলা খাওয়া পায়, পানি পায়, মাথার ওপরে ছাদ পায়। কারাগারের মানুষদের তো সকাল-সন্ধ্যা মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে ঘুম থেকে উঠতে হয় না। কারাগারের মানুষদের তো আর দুদিন পরপর চোখের জলে প্রিয় সন্তানদের কাফনের কাপড় পরিয়ে অন্ধকার কবরে রেখে আসতে হয় না। কিংবা ছিন্ন-বিছিন্ন সন্তানের মৃতদেহের কিছু অংশ হাসপাতালে রেখে এসে হারিয়ে ফেলা বাম হাত খুঁজতে আবার রাস্তায় নামতে হয় না। আমাদের আগে তিন পুরুষ অমানবিক অত্যাচারের মধ্যে দিয়ে পশুর মতো জীবন কাটিয়েছে। আমরাও একইভাবে পশুর মতো জীবন যাপন করছি; হয়তো একই পরিনতি হবে আমাদের সন্তানদের। কিন্তু তাদের সন্তানদের জন্য একটি মুক্ত, স্বাধীন ফিলিস্তিন রেখে যাব আমরা ইনশাআল্লাহ! ==সমাপ্ত== #FreePalestine #TearsOfGaza #JavedKaisar
Posted on: Tue, 12 Aug 2014 06:02:08 +0000

Trending Topics



Recently Viewed Topics




© 2015