জিয়া-ডালিম ও ১৫ আগস্ট লে. - TopicsExpress



          

জিয়া-ডালিম ও ১৫ আগস্ট লে. কর্নেল (অব) ডালিমের বয়ান মুনতাসীর মামুন (২৭ আগস্টের পর) ৫. সপ্তম থেকে দশম অধ্যায় পর্যন্ত আবারও ভারতীয় নীলনকশা, সিভিলিয়ানদের কাপুরুষতা, নিজের আহত হওয়া ও বাধ্য হয়ে বিয়ে করার ঘটনার স্মৃতিচারণ করেছেন। তার প্রধান ক্ষোভ ছিল সরকারের বিরুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধারা চরম কষ্টের মধ্যে থেকেও যুদ্ধ করেছেন। তাদের খাবার নেই, আশ্রয় নেই, অস্ত্র নেই। ভারতীয়রা অস্ত্র দিচ্ছে না। ভারতীয়দের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ, তারপরও কেন অস্ত্রের আশা করছিলেন? সরকার তাদের খোঁজ নিচ্ছে না। ভারতীয় নীলনকশাকে তিনি তাই নস্যাত করতে উদ্যোগী হলেন। ডালিম নিজেও কিন্তু আগে লিখেছেন, যারা সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তারাও কী দুরবস্থার মধ্যে কাটাচ্ছিলেন। সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছোট একটি ঘরে থাকতেন, সেখানেই অফিস করতেন। সবকিছুর জন্য সবাই নির্ভরশীল ছিল ভারতের ওপর। এক কোটি শরণার্থী এবং একটি সরকারের ব্যয়ভার গ্রহণ কি ভারতের পক্ষে সম্ভব ছিল? কিন্তু ডালিম তো আওয়ামী লীগকে পছন্দ করেন না। তাই তিনি লিখেছেন- “মুক্তিযোদ্ধাদের সব চাহিদাই পূরণ করা হবে বলে মুজিব নগর সরকারের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতিও পাওয়া গিয়েছিল কিন্তু যুদ্ধকালীন মুক্তিযোদ্ধারা কখনও পর্যাপ্ত পরিমাণে কিছুই পায়নি। ঠিক সময়মতো পাওয়া যায়নি অতি প্রয়োজনীয় যুদ্ধ সম্ভার। বর্ষাকালে জরুরী ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আচ্ছাদন নির্মাণের কথা থাকলেও সে আচ্ছাদন তৈরি করতে পারেনি আওয়ামী লীগ সরকার। মুক্তিযোদ্ধারা হাড় কাঁপানি শীতে রাত কাটিয়েছেন খোলা আকাশে নিচে। তাঁবু এবং শীত বস্ত্রের পর্যাপ্ত কোন বন্দোবস্তই করা সম্ভব হয়নি সরকারের পক্ষে।” [পৃ. ২০৮] ডালিম অস্থায়ী সরকার ও ভারতীয় প্রশাসনের চক্রান্ত ও স্বার্র্থ নিয়ে আলোচনা করেন এবং কিছু বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেন । তারা ঠিক করেন “সরকারের অযোগ্যতাকে নিয়ে বিশেষ উচ্চবাচ্য করা ঠিক হবে না। আমাদের বিভিন্ন মহলে উদ্দেশ্য এবং তাদের হীন উদ্দেশ্য হাসিলের চক্রান্তের ব্যাপারে সদা সচেতন থাকতে হবে। একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্গঠন করে তাদের সামরিক এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তুলতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে চক্রান্তের বিভিন্ন দিক। তাদের মটিভেট করতে হবে।” [পৃ. ২০৯] ডালিম তার ঐকমত্যের যেসব বন্ধুর নাম করেছেন তাদের অধিকাংশ কোন না কোনভাবে ১৯৭৫ সালের ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অসামান্য কৃতিত্ব ও দৃঢ়তার কথা তিনি লিখেছেন বার বার কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে উল্লেখ করেছেন, “মুজিবনগর সরকার কিংবা উচ্চপর্যায়ের নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে এ ত্যাগ ও বীরত্বের স্বীকৃতি কিংবা প্রশংসা তাঁরা খুব একটা পাননি কখনও। অবোধ্য কারণে তাদের সাফল্যকে ছোট করে দেখার প্রবণতাও স্পষ্ট ধরা পড়েছে ক্ষেত্রেবিশেষে। ফলে স্বাভাবিক কারণেই প্রবাসী সরকার এবং আর্মি হেডকোয়ার্টার্সের হোমরা-চোমরাদের প্রতি মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন ক্ষুব্ধ।” [পৃ. ২১৪] এ মন্তব্য সঠিক নয়। প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীবর্গ, সংসদ সদস্যরা যখনই সময় সুযোগ পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গেছেন, প্রশংসা করেছেন। তখন তাঁরা নিজেরা যে অবস্থায় ছিলেন এবং নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। সে অবস্থায় তাদের এর বেশি কিছু করার ক্ষমতা ছিল না। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক স্মৃতিকাহিনী আমি পড়েছি। সেখানে কীভাবে অপর্যাপ্ত অবস্থায় তারা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন সে সব বর্ণনা আছে। কিন্তু তাজউদ্দিন আহমদ বা তার সরকারের প্রতি কোন অনুযোগ নেই। ডালিম বোধ হয় ২৬.১২.১৯৭১ সালে তাজউদ্দিন আহমদের সরকারী ঘোষণার কথা ভুলে গেছেন। তাজউদ্দিন সরকারীভাবে দেশ, জাতি ও সরকারের পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। তার ভাষায় “ÒThe Government of the Peoples Republic of Bangladesh places on record, on behalf of the entire population of the country and the Government itself, of its deep sense of gratitude and profound thanks to all members of the Mukti Bahini (Regulars and Gono Bahini) The patriotism, courage and velour shown by the member of all the fighting forces, collectively and individually are unmatched, The sacrifices made by our valiant freedom fighters and the blood and sweat of all these who have fought in the war of liberation have not same in vainÓ” [মঈদুল, প্রাগুপ্ত, পরিশিষ্ট-ন. পৃ. ২৯৫] যারা দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন [নেতৃস্থানীয়] তাদের অনেকেই যথাযথ ব্যবহার করেননি, এটি অস্বীকারের উপায় নেই। ছাত্র নেতাদের শোনা যায়, অনেকে কলকাতা ছেড়ে যেতে অনীহা ছিল, নূরে আলম সিদ্দিকী একজনকে বিয়ে পর্যন্ত করে ফেলেছিলেন। ক্যাপ্টেন ডালিম প্রেমে পড়েছিলেন যার সেই নিম্মিকে যখন তার পিতা-মাতা কানাডা পাঠিয়ে দিতে চাইলেন তখন তা ডালিমকে জানানো হলো। ডালিম লুকিয়ে তাকে বিয়ে করলেন। নিম্মির পিতা, দূতাবাসের এস আর চৌধুরী তাজউদ্দিনকে এখবর জানালে তাজউদ্দিন যথেষ্ট বিরক্ত হন। জানিয়েছেন ফারুক আজিজ। পরে ডালিম এসে সব জানালে তাজউদ্দিনই আবার মধ্যস্থতা করে দেন। কিন্তু এই ডালিম বা সিদ্দিকীর ঘটনা দিয়ে শরণার্থী বা আশ্রয় প্রার্থীদের বিষয় বিবেচনা করা যাবে না। ডালিম লিখেছেন, “আওয়ামী লীগারদের লুটপাটের ইতিহাস শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়কালেই।” তারপর তিনি বলছেন, আমলা ও রাজনীতিবিদরা অনেক টাকা লুট করে এনেছেন, জমা দেননি। নাইট ক্লাবে আমোদ ফুর্তি করে বেড়াচ্ছেন। কিছু গালগল্পের কথা বলেছেন। এ প্রসঙ্গে আগে উল্লেখ করেছি। আরও লিখেছেন, “বিশ্বে বিভিন্ন দেশ থেকে ত্রাণ এসেছিল ভারতে। কিন্তু তার কতটুকুবা দেয়া হয়েছিল শরণার্থীদের প্রয়োজন মেটাতে।” [পৃ. ২২২] ইঙ্গিত ভারতও লুটপাট করেছে। যে দেশের সরকারকে এক কোটি লোককে খাদ্য ও আশ্রয় দিতে হচ্ছে ত্রাণ সামগ্রী চুরি করে কী করবে? লিখেছেন তিনি, “আমার জানামতে প্রাপ্ত রিলিফ সামগ্রীর একটা ক্ষুদ্র অংশই ভারত এবং প্রবাসী সরকারের উদ্যোগে বিতরণ করা হয়েছিল শরণার্থীদের সাথে। রিলিফ সামগ্রীর সিংহভাগই বেমালুম হজম করে নিয়েছিল ভারত সরকার।” [পৃ. ২৪১] আসলে পাকিস্তানীরা ডালিমদের মতো সৈনিকদের মনে, ভারতবিরোধিতার যে রোগ ঢুকিয়ে দিয়েছিল তার চিকিৎসা হয়নি এখনও। যে কারণে, এখনও বাঙালী সৈনিকদের কাছে ভারত শত্রু, বন্ধু হচ্ছে ১৯৭১ সালে পরাজিত পাকিস্তান। ৬. ভারতীয় রোগে সৈনিক ডালিম কী ভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন তা বোঝা যায় একাদশ অধ্যায় পড়লে। পুরানো অভিযোগগুলো আবার বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করে নিজের পক্ষপাত কোন্ দিকে তা স্পষ্ট করেছেন। প্রথম যে ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন তা হলো মোশতাকের আমেরিকা সফর। তার মতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা নাকি জানতে পারে, সিআইএর মাধ্যমে মোশতাক মার্কিন সরকার ও শেখ মুজিবের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। ‘নাকি’ শব্দ ব্যবহার করায় বুঝতে হবে, বিষয়টি সঠিক কিনা তা তার জানা নেই। এর পর তার ‘নাকি’র ব্যবহার নেই। অর্থাৎ তিনি যা বলছেন তাই সঠিক। তার ভাষ্য অনুযায়ী-“মার্কিন সরকারের মধ্যস্থতায় শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়া সরকারের সঙ্গে একটা চূড়ান্ত ফায়সালা করে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছে। এই চক্রান্তের খবর পেয়েই তাজউদ্দিন ভারত সরকারের নির্দেশে [শব্দটি লক্ষ্য করুন] ঐ পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হন [অবশ্য অজান্তে মোশতাকের কার্যকলাপকে আবার চক্রান্ত বলে উল্লেখ করেছেন] আরও জানা যায়- খোন্দকার মোশতাক আহমদ, ইয়াহিয়া সরকার এবং মার্কিন সরকারের ত্রিপাক্ষিক ঐ সমঝোতা আলোচনার প্রতি শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থন ছিল।” [ পৃ. ২৪০] আসলে প্রবাসী সরকার গঠনের পরপরই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ আন্দোলনের নেতার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে সমর্থ হয়। লরেন্স লিফসুলৎজ কার্নেগী নথিপত্রের ভিত্তিতে লিখেছেন – “What the Carnegie papers made unequivocally dear beyond a doubt is that secret contact were made with a faction of Bangladesh provisional Government, in the hope of splitting the independence movement and arriving at settlement short of independence. According to Carnegie interviews with an American Dos (Department of State) official, the contact were first began in June 1971.Ó [Lifschultz, L., Bangladesh: The Unfinished Revolution. London, p. 163 যে ক’জনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে যোগাযোগ হয়েছিল তার মধ্যে খোন্দকার মোশতাক অন্যতম। কিন্তু খোন্দকার মোশতাককে তো রক্ষার দায়িত্ব ডালিমের। কী ভাবে রক্ষা করতে চেয়েছেন তা উল্লেখ করছি। ডালিম এরপর বাংলাদেশ-ভারত ২৫ বছর মৈত্রী চুক্তির উল্লেখ করেছেন। তার মতে, ভারত সরকার স্বীকৃতি দিলে তার বিনিময়ে এই চুক্তি করা হয়। স্বীকৃতি দেয়া হয় ৬ তারিখে আর পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পণ করে ১৬ ডিসেম্বর। (চলবে)
Posted on: Wed, 27 Aug 2014 23:20:41 +0000

Recently Viewed Topics




© 2015