।। মুক্তির আলোয় হুমায়ূন - TopicsExpress



          

।। মুক্তির আলোয় হুমায়ূন ।। কয়েক বছর আগের কথা। ‘শ্যামল ছায়া’ ছবির কাজ শেষ হয়েছে। নুহাশপল্লীর বৈঠকঘরে স্যার শিল্পী ও কলাকুশলীদের সঙ্গে ছবির বিষয়ে আলাপ করছিলেন। তিনি সবাইকে প্রশ্ন করলেন, ‘বলো তো, এই ছবির সেরা দৃশ্য কোনটি?’ অনেকে অনেক দৃশ্যের কথাই বলছিল। সঠিক উত্তর একটাও হয়নি। শেষে স্যার দিয়েছিলেন উত্তর। বলেছিলেন, ‘ছবির শেষের দিকে ট্রলারের ছাদে দাঁড়িয়ে ডাক্তার আর ফারুক (ট্রলারের দুই চালক) বাংলাদেশের পতাকা দেখতে পেয়ে চোখের পানিতে পতাকাকে স্যালুট করছিল, সেটাই হচ্ছে ছবির সেরা দৃশ্য।’ আমার অভ্যাস ছিল, যেকোন দৃশ্য গ্রহণ শেষে আমি স্যারের দিকে চুপিসারে একটু তাকাতাম। দেখলাম, স্যারের চোখে পানি। তিনি হাত দিয়ে চোখ মুছছেন। বুঝে নিলাম, বাঙালি জাতির স্বাধীনতা অর্জনের দুঃখ-আনন্দের স্মৃতি তাঁকে কাঁদিয়েছে। -ডা. এজাজুল ইসলাম, প্রথমআলো, ১৯ জুলাই, ২০১৪। বাঙলাদেশের জন্য, তাঁর মাতৃভূমির জন্য হুমায়ূন আহমেদ-এর ভালোবাসা ছিল অন্যরকম। কোন শুকনো-পিরিত নয়, ভেজা-ভালোবাসা, রক্তেভেজা, রক্তমাখা-প্রেম। নিজের জন্মদাতা পিতাকে হারিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময়। যার হারায় সেই বোঝে কতো হারালো। এটা প্রায়ই বলা হয়ে থাকে, ১৯৭১-এ বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে যদি একজন করে শহীদ হতো, তাহলে বাঙালি বুঝতে পারতো ‘হারানোর ব্যাথা’ কাকে বলে! আমি কথাটার সাথে একমত নই। ব্যাথা অনুভব করার জন্যে সত্যি সত্যিই সবাইকে প্রতিটি ঘরে ঘরে হারাতে হবে কেন? আমাদের পরিবারে কেউ কি কোনদিন মারা যায়নি, কেউ হারিয়ে যায়নি! বিষয়টি আসলে দেশপ্রেমের, মাতৃপ্রেমের। ওখানটায় আমাদের ঘাটতি আছে হয়তো! হুমায়ূন আহমেদ জোছনা ও জননীর গল্পে ৩০০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন- এসডিপিও ফয়জুর রহমান সাহেবের পুত্রকন্যারা এবং তাঁর স্ত্রী আয়েশা বেগম নৌকায় বসে আছেন। আয়েশা বেগম রোজা রেখেছেন। স্বামির মঙ্গলের জন্য নফল রোজা। মাগ্রেবের সময় হয়ে গেছে। রোজা ভাংতে হবে। রোজা ভাঙ্গার কোন প্রস্তুতি নেই। সামান্য পানিও নেই যে পানি খেয়ে রোজা ভাঙা যায়। তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে দূর্গাপূর ইউনিয়নের বাবলা গ্রামে এক সম্পন্ন বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন। এসডিপিও সাহেবের স্ত্রী- সেই হিসেবে বাড়ির লোকজন তাদেরকে খুব আদর-যত্ন করছিলেন। হঠাৎ কী হয়ে গেল। বাড়ির কর্তা খসরু মিয়া (ছদ্ম নাম)* আয়েশা বেগমের কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, আমরা আপনাদের এই বাড়িতে রাখতে পারবোনা। বাড়ি ছাড়তে হবে। আয়েশা বেগম অবাক হয়ে বললেন, বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাব? বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাবেন- সেটা আপনি খুঁজে বার করেন। আমি নৌকা আনায়ে রেখেছি, নৌকায় উঠেন। আমি আপনাদের অঞ্চল কিছুই চিনিনা। বাচ্চাদের নিয়ে আমি যাবো কোথায়? আমার বড় বড় দুইটা মেয়ে আছে। আপনি খামাখা সময় নষ্ট করতেছেন। নৌকায় উঠতে বলছি, নৌকায় উঠেন। আমরা খবর পেয়েছি, আপনার স্বামীকে মিলিটারি মেরে ফেলেছে। আপনার দুই ছেলেকে খুঁজতেছে। আপনাকে এখানে রাখলে আমরা সবাই মারা পড়ব। আয়েশা বেগম বললেন, আজকের রাতটা থাকতে দিন। সকাল্বেলা আমি যেখানে পারি চলে যাব। অসম্ভব। নৌকায় উঠেন। সামান্য দয়া করেন। আমরা মহা বিপদে আছি। সবাই বিপদে আছে, এখন দয়া করাকরির কিছু নাই। খসরু মিয়ার হুকুমে জিনিসপত্র নৌকায় তোলা হতে লা্গল। আয়েশা বেগম তার ছোট মেয়ের হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে নৌকায় উঠলেন। নৌকার মাঝি বলল, আপনারা কোথায় যাবেন? তিনি বললেন জানিনা। ..................... একাত্তরে পরিবারের সাথে অজানা গন্তব্যে যাত্রা করে যে মানুষটি জীবনের এতখানি পথ পাড়ি দিলেন, তিনি আজ নুহাশপল্লীতে চিরনিদ্রায় শায়িত। প্রিয় বন্ধুগণ, এসডিপিও ফয়জুর রহমান আর লড়াকু আয়েশা বেগমকে নতুন করে কি আর পরিচয় করাবার প্রয়োজন আছে? হুমায়ূন আহমেদকে যাঁরা জানেন, তাঁর পিতা-মাতার পরিচয়টুকুও জানেন নিশ্চই। রাতের অন্ধকারে আয়েশা বেগমের পরিবারকে বাড়িথেকে বার করে দেয়া ‘খসরু মিয়া’রা কিন্তু এখনো বাংলাদেশেই বসবাস করে এবং বেশ শক্তি নিয়েই বসবাস করে। এই তেতাল্লিশ বছরে ‘ঝটিকা-আক্রমন’ চালিয়েছে ওরা বহুবার। খামছে ধরা জাতির পতাকা এখনো ছাড়েনি সেই পুরনো শকুণ। এদের বিরুদ্ধে কেউ-ই যখন কথা বলতে সাহস করেনা তখোন হুমায়ূন আহমেদ তাঁর টিভি নাটকে পাখীর মুখ দিয়ে বলিয়ে নিলেন “তুই রাজাকার”। কি অসাধারণ, অনবদ্য উপস্থাপনা। কী সুতীব্র প্রতিবাদ! জোছনা ও জননীর গল্পে আর একটি জায়গার কথা বলি। যেখানে একাত্তরের পঁচিশে মার্চ-পরবর্তী ভয়ংকর পরিবেশটি অসাধারণভাবে ফুটে উঠেছে। পৃষ্ঠা- ১৭০- .........সদর দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। শাহেদ অনেক্ষণ দরজা ধাক্কাবার পর ভেতর থেকে ভীত পুরুষগলা শোনা গেল- কে? শাহেদ বলল, আমি শাহেদ। দরজা খুলেন। শাহেদ অবাক হয়ে দেখে, দরজার ওপাশে গৌ্রাঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখ হলুদ। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে বিরাট কোন অসুখ থেকে উঠেছে। .............................. .............................. শাহেদ বলল, তুমি বাসায় ঢুকলে কীভাবে? গৌ্রাঙ্গ বিড়বিড় করে বলল, তালা ভেঙ্গে ঢূকেছি। মিতা, আমার কোনখানে যাবার জায়গা নাই!। তুমি যদি বের করে দাও, মিলিটারিরা আমাকে মেরে ফেলবে। শাহেদ বলল আমি বের করে দেব কেন? ................................. ................................. গৌ্রাঙ্গ সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমাল। কয়েকবার চেষ্টা করেও শাহেদ তাকে তুলতে পারলনা। সন্ধ্যার পর সে নিজেই জেগে উঠল। শাহেদ বলল, এখন শরীর কেমন? মাথা ঘোরা কমেছে? গৌ্রাঙ্গ বলল, শরীর ভাল আছে। আমার বাচ্চাটাকে মিলিটারিরা মেরে ফেলেছে- এই জন্যে মনটা সামান্য খারাপ। ভাবী? ভাবী কোথায়? ওরা তাকে তুলে নিয়ে গেছে। বাঁচিয়ে রেখেছে কি-না আমি জানিনা। মেরে ফেললে তার জন্যেও ভালো, সবার জন্যেই ভালো। আমার শ্বশুরসাহেবও মারা গেছেন। ................................. শাহেদ বলল, ভাবীকে যখন ওরা নিয়ে যাচ্ছিল তুমি কোথায় ছিলে? আমি দরজার আড়ালে বসে ছিলাম। ওরা সব ওলট পালট করে দেখেছে, শুধু দরজার আড়ালটা দেখে নাই। সবই ভগবানের লীলা। মিতা, তোমাকে যা বললাম সব গোপন রাখবে। মিলিটারির কানে গেলে তোমার বিপদ। আমারও বিপদ। শাহেদ বলল, ভাত-ডাল রান্না করেছি, খেতে আসো। গৌ্রাঙ্গ বলল, ঠিক আছে। খুবই ক্ষুধা লেগেছে। ইলিশ মাছের পাতুরি খেতে ইচ্ছে করছে। গরম ধোঁয়া উঠা ভাত, ইলিশ মাছের পাতুরি । কথা শেষ করেই গৌ্রাঙ্গ বিছানায় শুয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম। শাহেদ তার পাশেই বসে আছে। মানুষটা ঘুমের মধ্যে কাঁদছে। ঘুমের মধ্যে কাঁদার দৃশ্য যে দেখতে এত ভয়ংকর তা শাহেদ আগে কখনো বুঝতে পারেনি। বন্ধুগণ, এইরকম একটা ভয়ংকর অবস্থার ভেতরেও হুমায়ূন আহমেদ জীবন, মানুষ এবং তার মানবিক বিষয়গুলো বিশেষত ভালোবাসার ব্যাপারটি নিয়ে এসেছেন অত্যন্ত নিপুনভাবে। ওই গৌ্রাঙ্গ’র দৃশ্যেই উনি লিখছেন- রাত বাড়ছে। ইলেক্ট্রিসিটি সন্ধ্যা থেকেই নেই। ঘর অন্ধকার না। শাহেদ টেবিলের উপর পাশাপাশি দু’টা মোমবাতি জ্বালিয়েছে। মোমবাতি পাওয়া গেছে রান্নাঘরের তাকে। আসমানী রান্নাঘরের দরজায় লিষ্ট টানিয়ে রেখেছে। কোন জিনিসটি কোথায় তার তালিকা। প্রায়ই সে বাবার বাড়ি চলে যায়, তালিকাটা সে জন্যেই। আজ এই তালিকা পড়তে গিয়ে শাহেদের চোখে পানি এসে গেছে। চাল, ডাল, মুড়ি- টিনে ভরা। রুনির ঘরে। চৌকির নিচে। কাপড় ধোবার সাবান, মোমবাতি, দেয়াশলাই- রান্নাঘরের তাকে। সর্ববামে। মশলা, লবন- রান্নাঘরের তাকে। সর্বডানে। কৌ্টার গায়ে কী মশলা নাম লেখা আছে। চা, চিনি- মিটসেফের উপরে। পেঁয়াজ, রসুন, আদা- মিটসেফের পাশের খলুইয়ে। সরিষার তেল- চুলার পাশে। ভালোবাসা- আমার কাছে। আমি যেখানে থাকি সেখানে। এখানটাতেই হুমায়ূন আহমেদের ‘মাষ্টারি’। এখানেই উনি অসাধারণ, অনন্য, মানবিক, ভালোবাসায় সিক্ত এক পোড়খাওয়া মানুষ। উনার লেখা কয়েক’শ উপন্যাস থেকে অনেক উদাহরণ আজ দেয়া যেতো। কিন্তু ‘জোছনা ও জননীর গল্প’কে আমার মনে হয়েছে একাত্তরের একটি প্রামাণ্য-দলিল; যেটা নৃশংসতা, পাশবিকতা, মায়া মমতা, বন্ধুত্ব, প্রেম ভালোবাসার এক অদ্ভূত দালিলিক-সংকলন। হুমায়ূন আহমেদের হিমু, মিসির আলি, কবি কিংবা শত শত উপন্যাসের কথাতো বলাই যায়। কিন্তু, আমি আজ আমার ভালোলাগা একটি দিক নিয়ে আনাড়িভাবে আলোচনার চেষ্টা করলাম। হুমায়ূন আহমেদের মতো বিশাল আকাশকে নিয়ে কি দু’পাতায় মূল্যায়ন সম্ভব? তাঁকে মুল্যায়ন যথোপযুক্তরাই সময়মতো করবেন। আগেই বলেছি, আমি হৃদয় দিয়ে লিখি, কলম দিয়ে নয়। হুমায়ূন আহমেদেকে মূল্যায়ন করার মতো ধৃষ্টতা আমার নাই। সে চেষ্টা আমি কোনদিন করবোওনা। আজকের এই লেখা উনার প্রতি আমার হৃদয়ের উচ্ছাস মাত্র! Times of India -এর একটি কথা দিয়ে আজ ইতি টানবো। In recognition to the works of Humayun, Times of India wrote Humayun was a custodian of the Bangladeshi literary culture whose contribution single-handedly shifted the capital of Bengali literature from Kolkata to Dhaka without any war or revolution. Ahmeds writing style was characterized as magic realism. Sunil Gangopadhyay described him as the most popular writer in the Bengali language for a century. শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে, তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করে আজ রাখছি। * আমি অভ্র দিয়ে লিখে থাকি। এই অভ্র-তে কিছুতেই হুমায়ূন আহমেদের হু-টা ঠিকমত আসছেনা! আমি অসহায়, ক্ষমা করবেন। ============================================= হুমায়ূন আহমেদের সাথে আমার ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতার কথা নিয়ে আগামীকাল লেখার আশা রাখি। এখানে ব্যবহৃত ছবিগুলো Google থেকে নেওয়া। এ-সকল ফটোগ্রাফারদের প্রতি রইলো অভিবাদন।
Posted on: Sat, 19 Jul 2014 17:46:28 +0000

Trending Topics



INGREDIENTEs Tempo de preparo 50min Rendimento 4 porções
SATURDAY!!! SATURDAY!!! SATURDAY!!! Winding down to the last 6
Lupita Nyongoo Joins Cast of Star Wars Movie.s official, the force
Soooo.....I was in my garden picking beet greens and Swiss chard.

Recently Viewed Topics




© 2015