শুধুই ভালবাসি বলে by- Habiba - TopicsExpress



          

শুধুই ভালবাসি বলে by- Habiba Bristy বেশ নিরিবিলি আর ছায়াময় একটা পার্ক। মাঝামাঝি বড়সড় একটা পুকুরও আছে। পুকুর ঘিরে ছোট ছোট সিমেন্টের তৈরি বসার বেঞ্চ। তারই একটায় নিশু বসে আছে। ওর ইচ্ছে করছে পুকুরে ঝাপ দিয়ে মরে যেতে। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। কেননা ও সাতার জানে। এরচে তুর্য্যকে এই পুকুরে কয়েকটা নাকানি চুবানি দিতে পারলে নিশুর বেশি শান্তি লাগত। গত দু’ঘণ্টা থেকে তূ্র্য্যর অপেক্ষায় আছে সে। ইবলিসটা দেড় ঘণ্টা থেকে বলছে আর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আসছি। তূর্য্যকে কিভাবে ঘড়ি দেখানো শেখাবে ভ্রু কুঁচকে যখন এই নিয়ে ভাবছে নিশু, ঠিক তখনই তূর্য্য ওর সামনে এলো। আর ওর হাসি দেখে নিশুর পিত্তি জ্বলে উঠল। তোর সাথে আজ থেকে আমার সব সম্পর্ক শেষ। বেশ চেঁচিয়েই একথা বলে হনহন করে হাটা ধরল নিশু। ওর গলার স্বরের সাথে পাল্লা দিয়ে তূর্য্যও চেঁচিয়ে বলল, আমিতো এতদিন জানতাম তোর সাথে আমার একটাই সম্পর্ক। আর সেটা হল তুই আমার গার্লফ্রেন্ড। কিন্তু তুই যে মনে মনে আমাকে তোর বর ভেবে বসে আছিস এটা জানা ছিল না। ওর কথা শুনে নিশু থেমে গেল। পেছনে তাকিয়ে পূর্বের চেয়েও গলার স্বর আরও কয়েক ডেসিবেল বাড়িয়ে বলল, তোকে কে বলেছে আমি তোকে আমার বর ভাবি? তোর শব্দ ভাণ্ডারে বর শব্দের অর্থ কি কামের বেটা? ওমা তুই ই না বললি এইমাত্র, আমার সাথে তোর সব সম্পর্ক শেষ? যেহেতু ‘সব’ বলেছিস তারমানে প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্ক ছাড়াও আমাদের আরও এক বা একাধিক সম্পর্ক আছে। সেই এক বা একাধিকের প্রথমটা বর বউ ছাড়া আর কিইবা হবে বল? নিশু ফিরে এসে তূর্য্যর সামনে দাড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, একাধিকের পরেরগুলো কি? তূর্য্য মুখে একটুখানি লজ্জা মিশ্রিত হাসি এনে বলল, ইয়ে মানে আমার ছেলে মেয়ের মা। এরপর আমার ছেলের বউ আর মেয়ের জামাইয়ের দজ্জাল শাশুড়ি আম্মা। আর সবশেষে আমার নাতি নাতনীর নানিআম্মা। নিশু তূর্য্যর আরও সামনে এসে দাঁড়িয়ে কঠিন গলায় বলল, তুই যখন বখাটে ছিলি না? দিনরাত আমার পেছনে চরকির মত ঘুরতি, তখন তুই ছিলি আমার শত্রু। এরপর বাবাকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হেল্প করলি, সেদিনের পর থেকে আস্তে আস্তে হয়েছিস বন্ধু। আর তারপর আমাকে পটিয়ে পটিয়ে আমার প্রেমিক সেজেছিস। আজ থেকে তুই আমার প্রেমিক, বন্ধু, শত্রু কোনটাই না। এবার তোর মোটা মাথায় ঢুকেছে ‘সব সম্পর্ক’ এর মানেটা? তূর্য্য আহত গলায় বলল, তুই আমাকে বখাটে বলতে পারলি? হ্যাঁ পারলাম। শুধু বখাটে না, নিম্নশ্রেণীর বখাটে ছিলি তুই। লজ্জা শরমের ছিটেফোটাও ছিল না তোর মাঝে। তূর্য্য হাসল। তুই আগে বলবি না যে তোর উন্নতমানের বখাটে পছন্দ? আর শোন, প্লীজ একটু সাবধানে দাঁত কিড়মিড় কর। তোর দু একটা দাঁতও যদি ভেঙ্গে যায় তাহলে আম্মা কিছুতেই তোর সাথে আমার বিয়ে দিতে রাজি হবে না। নিশু বাজখাই গলায় চেঁচিয়ে উঠলো, চুপ। একদম চুপ। তূর্য্য দু’পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, আস্তে চিৎকার কর। গলায় যে দুটো ভোকাল কর্ড আছে, একটাও যদি ছিড়ে যায় চিল্লানো তো দূরের ব্যাপার কথাও বলতে পারবি না। আর আম্মা বোবা মেয়ের সাথেও কিছুতেই আমার বিয়ে দেবে না। নিশু তূর্য্যর দিকে ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকালো। এই দৃষ্টির নাম বিষদৃষ্টি। সাপের যেমন জিহ্বা দিয়ে বিষ ছিটানোর ক্ষমতা রয়েছে, মানুষকে যদি এই ক্ষমতা দেয়া হয় তাহলে তূর্য্য নির্ঘাত নীল হয়ে যেত এতক্ষনে। তূর্য্য ঢোক গিলল। নিশু বরফের ন্যায় শীতল গলায় বলল, এখান থেকে আর এক পা ও আমার পেছনে আসবি না। রাস্তা মাপ তোর। তুই কোথায় যাচ্ছিস একবার বল। তাহলে আর তোর পেছনে আসবো না প্রমিজ। ওই যে কোণার বেঞ্চটায় বুড়ো মতন লোকটাকে দেখতে পাচ্ছিস না? ওই লোকটার পাশে বসে তার সাথে বাদাম খাবো। হয়েছে এবার? নিশু হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো। কিছুক্ষন পর খেয়াল করলো, তূর্য্য ওকে পাশ কাটিয়ে বিদ্যুৎগতিতে ওর সামনে দিয়ে চলে গেলো। বেঞ্চের সামনে গিয়ে নিশুর চেহারা আবারও রাগে রক্তিম হল। তূর্য্য এক ঠোঙা বাদাম হাতে বুড়ো লোকটার পাশে বসে দাঁত কেলিয়ে কেলিয়ে গল্প করছে। নিশুকে দেখে অবাক হওয়ার ভান করে তূর্য্য বলল, কিরে? আমার পেছন পেছন এলি কেন? বাদাম খাবি? এই নে। তূর্য্যর বাড়িয়ে দেয়া ঠোঙা চটকা মেরে ফেলে দিয়ে নিশু বলল, থাবড়া চিনিস? ইয়ে মানে কিছু মনে করিস না, চিনতে পারলাম না। কে হয় তোর? নাম শুনে বুঝতে পারছি না পুংলিঙ্গ নাকি স্ত্রীলিঙ্গ। নিশু বা হাতে নিজের ডান হাত ডলতে ডলতে বলল, আয় চিনিয়ে দিচ্ছি। এমনভাবে চিনিয়ে দেব আর ইহজনমেও ভুলবি না। নিশুর হাত দেখে তূর্য্য আবারও ঢোক গিলে মিনমিনে কণ্ঠে বলল, হ্যাঁ মনে পড়েছে। চিনি তো। ওই যে সেবার মার্কেটে সবার সামনে চিনিয়ে দিলি না? বুড়ো ভদ্রলোক দুজনের ঝগড়া দেখে মিটিমিটি হাসছিলেন। তিনি বললেন, আমার বোধহয় অন্য কোথাও গিয়ে বসা উচিত। নিশু বলল, না না, আপনি আপনি উঠবেন কেন? উড়ে এসে জুড়ে বসেছি তো আমরাই। আমার কোন সমস্যা নেই। তোমরা চাইলে এখানেই বসতে পারো। নিশু বসতে বসতে বলল, ধন্যবাদ। তবে ওই রামছাগলটাকে দূরে গিয়ে কাঁঠালপাতা চিবুতে বলুন। তূর্য্য চারপাশে তাকিয়ে দুজনের মাঝখানে বসা ভদ্রলোককে বলল, আপনার পরিচিত কোন ভালো আই স্পেশালিষ্ট আছে? ভদ্রলোক বললেন, হ্যাঁ আছে একজন। তোমার সমস্যা নাকি অন্য কারও জন্য? আচ্ছা আপনিই বলুন, আপনি কি দূর দূরান্ত পর্যন্ত কোন রামছাগলকে কাঁঠালপাতা চিবুতে দেখছেন? ভদ্রলোক হাসলেন। নিশু বলল, চাচা আই ডোনেশনের ব্যাপারে কিছু জানেন? ওহ স্যরি, আপনাকে চাচা বলতে পারি আমি? হ্যাঁ অবশ্যই। একজন ৪৮ বছর বয়সী প্রবীণকে চাচা ডাকাই সমীচিন নয় কি? এতে স্যরি হওয়ার কি আছে? আমি অরণ্য হাসান। তোমাদের নামগুলো জানা হয়নি। নিশু আর তূর্য্য ওদের নাম বলল। অরণ্য হাসান বললেন, এবার নিশু বলো আই ডোনেশন এর কথা বলছিলে কেন? নিশু বলল, চাচা একটু পরে আপনার সামনে ওই রামছাগলটার চোখদুটো গেলে দেবো কিনা। তূর্য্য অসহায় এর মত গলা খাকারি দিলো। অরণ্য হাসান আবারও হাসলেন। তোমরা একে অন্যের উপর ভীষণ রেগে আছো তা বুঝতে পারছি কিন্তু কারণটা তো না বললে বুঝবো না। তোমরা অবশ্যি চাইলে আমাকে বলতে পারো। দেখি তো ঝগড়া মেটানোর কোন উপায় বাতলাতে পারি কিনা। অরণ্য হাসানের কথা শুনে তূর্য্য খুশি হয়ে যেই মুখ খুলতে উদ্যত হলো নিশু তখনই বলে উঠল, চাচা আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না। আপনার ডানপাশে বসা হোমো স্যাপিয়েন্স এর সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। কিছুক্ষন আগে সব সম্পর্কের ইতি টানা হয়েছে। বলো কি? হুম ঠিকই বলেছি। অরণ্য হাসান অবাক হয়ে তূর্য্যর দিকে তাকালেন। তূর্য হেসে বলল, আমি ডিভোর্স পেপারে সাইন করিনি এখনও। ওহ তোমরা বিবাহিত? নিশু তূর্য্যর দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে অরণ্য হাসানকে বলল, চাচা ওই ঘটিরামের কথায় কান দেবেন না। তার সাথে আমার দীর্ঘ এক বছরের প্রেম ছিল যা একটু আগে শেষ হয়েছে। হুম। তবে তূর্য্যর মুখ দেখে মনে হচ্ছে একতরফা রায় ঘোষণা হয়েছে। একথা শুনে তূর্য্য সমানে উপর নিচ মাথা ঝাকালো। নিশু বলল, চাচা আপনি আসামীপক্ষের উকিল সাজতে চাইছেন কেন? অরণ্য হাসান হা হা করে হেসে উঠে বললেন, আচ্ছা আমি না হয় রাষ্ট্রপক্ষেরই উকিল হবো। তাই ঘটনা কি জানতে চাই। তূর্য্য বলল, চাচা হয়েছে কি, আমি আজ... নিশু ধমকে বলল, চুপ। আমি বলছি। চাচা তার আগে বলুন, আপনি নিশ্চয়ই বিবাহিত। চাচীর সাথে কি লাভ ম্যারেজ হয়েছে নাকি অ্যারেঞ্জড? তোমাদের চাচী আর আমি রীতিমত পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম। সত্যি? হুম সত্যি। তাহলে আপনি খুব ভালো করেই বুঝবেন আমার ব্যাপারটা। আপনি কখনও চাচীকে দু’ঘণ্টা বসিয়ে রেখেছিলেন দেখা করবেন বলে? বিয়ের আগে আমরা কেউ কাউকে অপেক্ষায় রাখবার সুযোগ পেতাম না। তবে এখন তোমার চাচী আমাকে দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর গোনায়। নিশু অবাক হয়ে বলল, সুযোগ পেতেন না মানে ঠিক বুঝলাম না। আমরা কাউকে অপেক্ষায় রাখতে নয় বরং নিজেরা অপেক্ষায় থাকার অপেক্ষায় থাকতাম। অপেক্ষার স্বাদটুকু নিতে চাইতাম। কিন্তু যেদিনই আমাদের দেখা করার কথা থাকতো, সেদিন শুভ্রা মানে তোমার চাচী আর আমি দুজনই ঘণ্টাখানেক আগেই এসে পড়তাম। নিশু ওর দু’ঠোঁটের মধ্যবর্তী দূরত্ব কমাতে কমাতে বলল, বিশ্বাসই হয় না। এমনও হয় নাকি? এত ভালবাসতেন দুজন দুজনকে! চাচা একটা আবদার করি? হুম করো। চাচা আপনার আর শুভ্রা চাচীর গল্প খুব জানতে ইচ্ছে করছে। বিয়ে পালানো গল্প। তূর্য্য বলল, হ্যাঁ চাচা প্লীজ বলুন। আপনার কথা শুনে যদি কেউ ভালবাসার সংজ্ঞা নতুন করে শিখতে পারে। অরণ্য হাসান বললেন, আমাদের গল্পটা তো খুব ছোট। সত্যিই শুনতে চাও? তূর্য্য নিশু দুজনই হ্যাঁ বলল। অরণ্য হাসান বলতে শুরু করলেন, শুভ্রা আর আমি একই ভার্সিটিতে পড়তাম। আমার দু’বছরের জুনিয়র ছিল ও। দু’বছরে কখনও দেখা হয়নি আমাদের। একদিন ক্যাম্পাসে হঠাৎ ঝামেলা বেঁধে যাওয়ায় মুহূর্তেই ক্যাম্পাস খালি হয়ে গেলো। আমিও বাসার পথে পা বাড়ালাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম, সাদা সালোয়ার কামিজ পড়ুয়া এক তরুণী বড় গেইটটার এক কোণে বসে অঝোরে কাঁদছে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কাঁদছেন কেন? তরুণী আমার দিকে চোখ তুলে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে তার কান্নায় পুনরায় মনোযোগ দিলো। এরপর গুনে গুনে পাঁচবার জিজ্ঞেস করার পর আচমকা সে তার ডান পা তুলে দেখালো আমাকে। হতভম্ব আমার বুঝতে কয়েক মুহূর্ত পেরিয়ে গেলো যে তরুণী আমাকে লাথি নয় তার কেটে যাওয়া পা দেখালো। যার কারনে সে হাঁটতে পারছে না। আর ভীষণ লজ্জাবতী ও চুপচাপ স্বভাবের হওয়ায় সে কাউকে সাহায্যের জন্য ডাকতে পারে নি। নিশু বলল, তারপর কি হলো? তারপর সেই লজ্জাবতী তরুণীকে অনেক অনুরোধের পর আমার সাথে করে হসপিটালে নিয়ে যেতে রাজি করালাম। নিশু অবাক হয়ে বলল, অনুরোধ কেন? লজ্জাবতী কোন ছেলের সাথে যেতে রাজি ছিল না। তাকে এটা বোঝাতে হয়েছিল যে ক্যাম্পাসে ঝামেলার কারনে সবাই চলে গিয়েছে। সারাদিন বসে থাকলেও কোন ফেমিনিন জেন্ডারের দেখা সে পাবে না। এই লজ্জাবতী তরুণীই ছিল শুভ্রা। শুভ্রা হলো ওর নামের মতই শুভ্র। এত কম কথা বলত যে মানুষ ওকে বোবা ভেবে ভুল করতো মাঝে মাঝে। তবে সৃষ্টিকর্তা তার সৃষ্টির সমস্ত মায়া বুঝি শুভ্রার চোখদুটোতে ঢেলে দিয়েছেন। ওর কণ্ঠ মন ভরে শুনতে না পাওয়ার শূন্যতাটা একটু বেশিই পূরণ করে দেয় ওর চোখদুটোতে থাকা মায়ার পাহাড়টা। শুভ্রার নিষ্পাপ চাহনি ওর মন বাড়িটার প্রত্যেকটা কোণা পরিস্কারভাবে দেখিয়ে দেয়। অরণ্য হাসান থামলেন। তূর্য্য বলল, এরপর কি হলো? এরপর শুভ্রার পাশে দীর্ঘ এক বছর বন্ধু হয়ে থেকে ওর চোখে আমার জন্য সেই বহু প্রতীক্ষিত ভালবাসার আশ্রয় দেখতে পেলাম। তারপর শুধুই হারিয়ে যাওয়া। কখনও অন্তরীক্ষের নীলের মাঝে বিলীন হওয়া। কখনও নদী তীরের কাশফুলের শুভ্রতায় বিভোর হওয়া। আর কখনও বা দিগন্তজোড়া ধানক্ষেতের সবুজে সুখপাখিটাকে খুজে ফেরা। চলে যেতাম পথ হারানো পথটার শেষ প্রান্তে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতাম কোন কথা ছাড়া। শুভ্রা শুধু শক্ত করে আমার হাতটা ধরে থাকত। মনে হতো হাত ছাড়লেই বুঝি আমি পালিয়ে যাবো। আমাদের শরীরের প্রতিটা ইলেকট্রন বুঝি তখন ব্যস্ত থাকত মনের কথাগুলোকে এই হাতদুটো দিয়ে দুজনের মাঝে স্থানান্তর করতে। ছ’মাসের মাথায় দুজনের বাসায়ই রাজি করিয়ে ফেললাম। শুভ্রার পরীক্ষা চলছিল। ঠিক হলো ওর পরীক্ষা শেষেই বিয়ের পিড়িতে বসবো। ওই সময়টা ছিল স্বপ্ন বোনার। শুভ্রার চোখে হাজারো স্বপ্ন খেলা করত ওর আগত সংসার নিয়ে। নিশু বলল, আপনি তো বললেন আপনারা পালিয়ে বিয়ে করেছেন? হুম, শুভ্রার সাথে বিয়ের পনের দিন আগে একটা ছোট্ট অ্যাকসিডেন্ট করে হসপিটালে যেতে হলো আমাকে। জ্ঞান ছিল না। শুভ্রার ফোন রিসিভ করলো আমাকে হসপিটালে নিয়ে আসা ভদ্রলোক। দুর্বল স্নায়ুর শুভ্রা কি বুঝল কে জানে। হাত থেকে ফোনের সাথে সাথে শুভ্রার শরীরটাও মেঝেতে পড়লো। স্ট্রোক করেছিল ও। সুস্থ হয়ে বাড়িও ফিরলো। তবে সঙ্গী হলো হুইল চেয়ারটা। পা দুটো প্যারালাইসড হয়ে গেল শুভ্রার। আর বিয়েটা ভেঙ্গে দিলো আমার বাবা মা। শুভ্রা ওর স্বপ্নগুলোকে হারিয়ে ফেললো। আমি অনেক চেষ্টা করেও বাবা মাকে রাজি করাতে পারলাম না। ঠিক করলাম,শুভ্রার স্বপ্নগুলোকে হারিয়ে যেতে দেবনা। অনেক বোঝানোর পর শুভ্রা হার মানলো আমার জেদের কাছে। এরপর এক শুভ্র সকালে শুভ্রাকে নিয়ে পালিয়ে গেলাম। শুভ্রা হুইল চেয়ারে। আর হুইল চেয়ারের পেছনে আমি। অরণ্য হাসান বন্ধ চোখের পাতা মেললেন। বললেন, এইতো আমাদের পালানোর গল্প। নিশুর চোখ ছলছল করছে। ও কান্না আটকে বলল, চাচা আমি আরও একটা আবদার করতে চাই। আমি শুভ্রা চাচীর সাথে সেখা করতে চাই। অরণ্য হাসান ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমিও সে অপেক্ষাতেই আছি। মানে? চাচী কোথায় এখন? সেদিন পালিয়ে বিয়ে করার তিনমাস পাঁচদিন পর শুভ্রা আমাকে ছেড়ে ওপারে চলে গেলো। এই মেয়ে কাঁদছ কেন? নিশু চোখ মুছতে মুছতে বলল, আমি স্যরি চাচা। অরণ্য হাসান মৃদু হেসে বললেন, বোকা মেয়ে। জানো ২১ বছর আগে শুভ্রা আমাকে বিশ্বাস করিয়ে দিয়ে গিয়েছিল যে এই ক্ষণস্থায়ী জগতটার বাহিরে আরেকটা জগত আছে যেখানটায় শুভ্রাকে কেউ আমার থেকে কখনই কেড়ে নেবে না। ও বলেছিল, ও আমার অপেক্ষায় থাকবে। তবে আমি যেন প্রকৃতির নিয়মেই ওর কাছে যাই। আজ ২১ বছরেও আমার অপেক্ষা ফুরোয়নি। কই মাছের প্রান নিয়ে এসেছি বুঝেছ? নিশুর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। তূর্য্য চোখের জল লুকিয়ে ফেলবার পারদর্শিতা দেখিয়ে ফেলেছে ইতোমধ্যেই। নিশু বলল, চাচা আপনি একা একা এতটা সময় কি করে পার করলেন? আবার বিয়ে করলেন না কেন? শুভ্রা বলেছিল আমি যেন বিয়ে করে ওর স্বপ্নগুলোকে পূর্ণতা দেই। হাসতে হাসতে বলেছিল, আমি দুটো বিয়ে করলেও নাকি ওপারের জগতটায় গিয়ে আমার দুটো অস্তিত্ব হয়ে যাবে। একজন ওর কাছে থাকবে আর অন্যজন সেই দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছে থাকবে। তবে আমি শুভ্রার মত অতটা উদার মনের হতে পারি নি। ও যদি ওপারে গিয়ে আমার জন্য একলা অপেক্ষায় থাকতে পারে তবে আমি কেন এপারে পারবো না? চাচীকে খুব বেশি মনে পড়ে তাইনা? তূর্য্যর প্রশ্ন শুনে অরণ্য হাসান বললেন, যে শ্বাস প্রশ্বাসের মধ্যবর্তী সময়টাতে থাকে তাকে আলাদা করে মনে করতে হয় বুঝি? হ্যাঁ, শুভ্রা চলে যাওয়ার প্রথম কিছুদিন মনে হতো ওকে ছাড়া আমার পৃথিবীটায় শুধুই আঁধার প্রতিদিন। মন খারাপটাকে এরপর আর ডানা মেলতে দিইনি কখনও। কারন আমি কষ্টে থাকলে ও কষ্ট পাবে। তাই ওকে সাথে নিয়েই হাসি আমি, ওকে ভুলে থাকার চেষ্টায় নয়। অনেকেই বলেছিল, ভীষণ ব্যস্ত হয়ে যেতে। অনেক মানুষের ভীরে থাকতে। তাদের কি করে বোঝাই শুভ্রার শূন্যতাটা যে সবচে বেশি অনুভব করি কোলাহলের মাঝেই। অরণ্য হাসান কিছুক্ষণ থেমে বললেন, শুভ্রা আমার স্পর্শের বাহিরে তো কি হয়েছে? স্মৃতির চাদরে ও সারাক্ষন আমায় ছুঁয়ে থাকে। আমার কখনই নিজেকে একা মনে হয়না। শুভ্রা আছে আমার চারপাশে স্মৃতির আরশি জুড়ে। অলস ভোরের নরম রোদের উষ্ণতায়, সূর্যের সাথে জেগে ওঠা ব্যস্ত পাখিদের গানের সুরের মাঝে, শিশির ভেজা ঘাসের সজীবতায়, বৃষ্টির কণায়, দেয়াল ঘড়িটার টিকটিক শব্দে, নীলের মাঝে শুভ্র গাংচিল এর ডানায়, কফির মগটায় চামুচ এর টুংটাং শব্দে, একজোড়া নরম হাতের ছোঁয়া হারানো টিভির রিমোটটায়, বৃষ্টিতে আধভেজা অসহায় দাঁড়কাকের নিশ্চুপতায়, আঁধারের নিঃশব্দটায়, জোনাকির সবুজ হাসিতে, জোছনার মায়ায়। শুভ্রা আছে কবিতার শুরু থেকে শেষ অবধি, নিথর কোলবালিশটায়, মুঠোফোনের নিরবতায়, আলস্যে, ব্যস্ততায়, ফুলের মালা হাতে পথশিশুটার নিষ্পাপ চোখের আকুতিতে। শীতের রাত্রিতে হঠাৎ শুরু হওয়া ঝড়ো হাওয়ায়, যার দ্বারা যেন শুভ্রা শরীরে কাপন তুলে জানান দেয় ‘আমি আছি’। নিশু ক্রমাগত কাঁদছে। তূর্য্য প্রানপন চেষ্টা করেও এবার ওর চোখভর্তি জল আটকাতে পারল না। অরণ্য হাসান বললেন, তূর্য্য নিশু চোখ মুছে ফেলো। আমিই শেষ কবে চোখের জল ফেলেছি মনে নেই। শুভ্রা আমার খোলা চোখে স্বপ্ন হয়ে থাকে সবসময়। খোলা চোখের স্বপ্নগুলো অনেক বেশি শক্তিশালী হয় জানো তো? আর আমি তো প্রতীক্ষায় আছি। স্মৃতিগুলোকে পুনরায় বাস্তবে নিয়ে আসবার প্রতীক্ষায়। আমি জানি আমার প্রতীক্ষা একটু দেরীতে হলেও ফুরোবে। অরণ্য হাসান ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, একটা জীবন খুব বেশিই ছোট ভালবাসার মানুষগুলোকে সাথে নিয়ে বেঁচে থাকতে, তাদের ইচ্ছেমত ভালবাসতে। যখন এই মানুষগুলোর একজনও হারিয়ে যায়, তখন সেই মানুষটার সাথে বসে শুধুমাত্র কয়েকটা নিশ্চুপ নিঃশ্বাস ফেলবার সময়টুকুও স্মৃতির খাতাটার অনেকগুলো পৃষ্ঠা দখল করে ফেলে। যা কিনা মানুষটা পাশে থাকতে কখনই বুঝে উঠতে পারে না অধিকাংশ মানুষ। আমি চাই তোমরা সেই ‘অধিকাংশ’ এর বাইরের দলের মানুষ হও। ভালো থেকো। অরণ্য হাসান উঠে দাঁড়ালেন। তিনি এখন বাসায় ফিরবেন। শুভ্রার সাথে তিনি পাঁচটা পর্যন্তই পার্কে বসতেন। পাঁচটা বেজে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে অরণ্য হাসান আকাশের দিকে তাকালেন। আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। আজও হয়তো বৃষ্টি হবে। পেছনে জলভর্তি চোখে নিশু আর তূর্য্য আজকের মত ঝগড়ার ইতি টানতে গিয়ে আবারও ঝগড়া বাঁধিয়ে ফেলেছে। তবে এই ঝগড়ার অন্তরালে উকি দেয়া ভালবাসাগুলো দেখতে ভুল করছে না দুজনের কেউই।
Posted on: Tue, 15 Oct 2013 08:07:18 +0000

Trending Topics



Recently Viewed Topics




© 2015