: ১ সারাদিন পর হানিফ - TopicsExpress



          

: ১ সারাদিন পর হানিফ সাহেব ঘরে ফিরে দেখলেন বাসায় কেউ নেই। বাসার দারোয়ান জানাল রুমকি, শুভ এবং তার মা একটা জন্মদিনের দাওয়াতে গেছেন। হানিফ সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। রিটায়ারমেন্টে যাবার পর থেকে বাসার অনেক খবরই তাকে দেওয়া হয় না। অথচ এখন তার অখণ্ড অবসর। সারাজীবন কাজের ব্যস্ততার জন্য ছেলেমেয়েদের সাথে খুব বেশি সখ্যতা হয়নি। ফলে এখন দূরত্বটা পর্বতাকৃতির হয়ে গেছে। মিসেস হানিফ কেন জানি আজকাল তার সব কথাতেই বিরক্ত হন। রুমকি রাতে একা ঘুমাতে ভয় পায়, তাই তিনি এখন গেস্ট রুমে ঘুমান এবং রুমকি তার মায়ের সাথে বেডরুমে ঘুমায়। শুভ পাশ করে খুব ভাল একটা চাকরিতে জয়েন করেছে। একটা মেয়েকে নাকি সে পছন্দও করে, তাকেই বিয়ে করবে বছরের শেষতক। একথা অবশ্য তাকে বাসার কেউ জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি। তিনি রুমকির মা কে একদিন ফোনে কথা বলতে শুনেছিলেন। সেই থেকে জানেন। কাজ ছাড়া থাকতে ভাল লাগেনা হানিফ সাহেবের। রিটায়ারমেন্টে যাওয়াটা তার কাছে অভিশাপ বলে মনে হয়। অবশ্য ৩৫ বছর কাজ করার পর একটি প্রতিষ্ঠানকে দেবার মত তার কাছে আর কিছুই নেই। বাসার মানুষজনকে আজকাল খুব অচেনা মনে হয় তার। নিজেকে কেমন জানি অবাঞ্ছিত লাগে। একা এক কোণের ঘরে পরে থাকেন উনি। আর প্রচুর বই পড়েন। নিজের জমানো কিছু পুঁজি দিয়ে শেয়ার ব্যবসা শুরু করে ছিলেন। কিন্তু তার অবস্থাও মহা শোচনীয়। মাঝে মাঝেই উনার ভীষণ গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সেখানে আর এখন কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। তাই ইচ্ছেটাও যেন অন্তঃসারশূন্য একটি ইচ্ছে। ক্রিং ক্রিং করে বাসার ল্যান্ডফোনটা বাজছে। হানিফ সাহেবের ভাবনায় ছেদ পড়ে। এ বাসায় সবারই ব্যক্তিগত মোবাইল আছে। ল্যান্ডফোনটা প্রায় বাতিলের খাতায় নাম লিখিয়েছে। কেউ ব্যবহার করেনা। কয়েক মাস ধরে বিলও পরিশোধ করা হচ্ছেনা। এই অবস্থায় ফোন আসা সত্যিই বিস্ময়কর। হানিফ সাহেব ফোন ধরলেন- -হ্যালো। -হ্যালো আব্বু! ওপাশ থেকে একটা বাচ্চার রিনরিনে গলা ভেসে আসে। -কাকে চাইছো তুমি? কি নাম তোমার? -তোমাকে আব্বু। আমি নিলয়। -আমি তো তোমার আব্বু নই। তুমি কত নাম্বারে ফোন করেছ নিলয়? -এই নাম্বারেই তো আব্বু। তুমি রেগে আছ তাই এমন করে বলছ? প্রমিস আমি তোমার সব কথা শুনবো। প্লিজ … হানিফ সাহেব ফোন ধরে রেখেছেন। ওপাশ থেকে কথা ভেসেই আসছে। -জানো! আজকে আমি এলবাম থেকে তোমার ফটো দেখছিলাম আর আম্মু সেটা কেড়ে নিয়ে গেলো। She is very rude. তারপরেই গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল- তোমাকে যে আমি ফোন করসি আম্মুকে বলোনা। নইলে সে আমাকে অনেক মারবে। -আচ্ছা বলবোনা। কিন্তু তোমার আম্মু কোথায়? -সে তো নেলী আন্টিদের বাসায় গেছে। জানো আব্বু, আজকে সকালে কি হয়েছে... খুট করে ফোনের লাইনটা কেটে গেলো এরপর। ২ দিনের শুরুতেই ছোট একটা পানির বোতল নিয়ে হানিফ সাহেব শেয়ার মার্কেটে চলে যান। সারাদিন সেখানে কাটিয়ে এসে গতরাতের ফোনের কথা তিনি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। রাতে খাবার খাওয়ার সময় মনে পড়লো, তার নিলয় নামের বাচ্চাটার কথা। গতকাল রাতে ছেলেটা তার গল্প শেষ করতে পারেনি। কে জানে হয়ত তার মা চলে এসেছিল। দুই দিন পর। রাত ৩টা। ক্রিং ক্রিং করে ল্যান্ডফোনটা বেজে যাচ্ছে। বয়স হয়ে যাবার কারণে আজকাল হানিফ হাসেবের ঘুম খুব পাতলা হয়। ফোনের শব্দে ঝট করে ঘুম ভাঙ্গে তার। বাসার অন্য সবাই ঘুমিয়ে আছে। এত রাতে ফোনের শব্দে জেগে গেলে মহা কেলেঙ্কারি হবে। হানিফ সাহেব তাই নিজেই উঠে গেলেন ফোন ধরতে। -হ্যালো আব্বু! ফিসফিস করে বলে নিলয়। -হ্যাঁ বল। -আমার না খুব ভয় লাগছে, পচা স্বপ্ন দেখেছি। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলে নিলয়। বাচ্চাটার নিষ্পাপ গলা শুনে এক মুহূর্তের জন্যে হানিফ সাহেব তার স্থান, কাল, পাত্র ভুলে যান। নরম কণ্ঠে বলেন- -কি হয়েছে বাবা? -আমি ভয় পাইসি আব্বু। A big monster was in my dream. গলার স্বর কেঁপে উঠে নিলয়ের। -ধুর বোকা। স্বপ্ন তো স্বপ্নই! ভয় কেন পাচ্ছো? আমি তোমাকে একটা super power দিয়ে দিব তোমার আর ভয় লাগবে না। বরং সব monster তোমাকেই ভয় পাবে। -সত্যি! নিলয়ের গলায় খুশি ঝরে পড়ে। আব্বু তুমি আমার পাশে একটু থাকনা প্লিজ। আমার একা ঘুমাতে ভয় করছে। হানিফ সাহেব ছোট্ট এই ছেলেটার প্রতি অদ্ভুত একটা মমতা অনুভব করেন। একটু থেমে বলেন- -আছি তো বাবা। -তুমি আমাকে rhyme শুনাওনা আব্বু। ওপাশ থেকে ফিসফিস করে বলে নিলয়। -rhyme কাকে বলে? আমি তো পারিনা। আমি বরং আমার একটা পছন্দের কবিতা বলি। Shakespeare এর কবিতা। Shakespeare নাম শুনেছ? ভরাট গলায় বলতে শুরু করেন হানিফ সাহেব... Shall I compare thee to a summers day? Thou art more lovely and more temperate: Rough winds do shake the darling buds of May, And summers lease hath all too short a date: Sometime too hot the eye of heaven shines, And often is his gold complexion dimmed, And every fair from fair sometime declines, By chance, or natures changing course untrimmed: But thy eternal summer shall not fade, Nor lose possession of that fair thou owst, Nor shall death brag thou wanderst in his shade, When in eternal lines to time thou growst, So long as men can breathe, or eyes can see, So long lives this, and this gives life to thee. এই কবিতাটি Shakespeare তার পরম বন্ধুর জন্যে লিখেছিলেন। প্রকৃতির বিভিন্ন রূপের সাথে তিনি তাকে তুলনা করে বলেছিলেন, তার অনুভূতি আসলে কোন কিছুর সাথেই তুলনাযোগ্য নয়। একেক সময়ে একেক ঋতু আসে কিন্তু মনের অনুভূতি তো বদলায় না তবুও। এ অনুভূতি তুলনাহীন...এই অনুভূতি বর্ণনাতীত। বুঝেছ নিলয়! হ্যালো... ওপাশ থেকে ভারী নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ আসছে। নিলয় ঘুমিয়ে গেছে। ৩ হানিফ সাহেব আজকাল বেশ আছেন। ছোট্ট একটা শিশু তার আটপৌরে জীবনের রঙ বদলে ফেলেছে। নিলয়ের সাথে মাঝে মাঝেই তার ফোনে কথা হয়। সে প্রোগ্রেসিভ ইন্টঃ স্কুলের জুপিটার সেকশনের ছাত্র। কিন্তু হানিফ সাহেবের আফসোস তিনি নিলয়কে কখনো ফোন করতে পারেন না। কারণ নিলয় তার বাসার ফোন নাম্বার মুখস্থ বলতে পারেনা। অবশ্য খুব বেশি সমস্যাও হয়না। নিলয় প্রায়ই ফোন করে, আর এমন সময় ফোন করে যখন বাসায় কেউ থাকে না বা বাসার সবাই ঘুমায়। হানিফ সাহেবও তখন কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। নিজেকে তার ৫/৬ বছরের মায়া কাড়া এই ছেলেটির বাবা ভাবতে খুব ভালো লাগে। নিলয়ের বাবামার ব্যাপারে তিনি প্রায় কিছুই জানেন না। শুধু জানেন, নিলয়ের মা একটা অফিসে কাজ করে। এর বেশি কিছু নিলয় বলতেও পারেনা। আর তাদের দুজনের অফুরন্ত কথায় আসলে অন্য কারো কথা খুব একটা আসেনা। এভাবেই দিন বেশ কেটে যাচ্ছিল। একদিন হঠাৎ করে হানিফ সাহেব বাসায় ফেরার পথে কি মনে করে নিলয়ের জন্যে একটা প্লে ষ্টেশন সিডি ও একটা স্পাইডারম্যানের ছবিওয়ালা টি-শার্ট কিনে ফেললেন। কেন কিনলেন তা নিজেও জানেন না। সে রাতে নিলয় ফোন করলো না। তারপরের দিনও না। হানিফ সাহেবের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। তিনি ছটফট করছেন। ঠিকমত খেতে বা ঘুমাতেও পারছেন না, মাঝ রাতে চোখের পাতা লেগে আসলে কানের কাছে তিনি ফোনের রিং শুনতে পান। আর তার ঘুম আসেনা। এদিকে রুমকির মা হুট করেই সিডি আর টি-শার্ট দেখতে পেয়েছে, তারপর বাসায় তুমুল হৈ চৈ শুরু করে দিয়েছে। শুভকে বলেছে- তোর বাপ নিশ্চয় আরেকটা বিয়ে করসে, সেই ঘরের সন্তানের জন্যে এই সব জিনিষপত্র। বাসার অবস্থা খুব খারাপ, তার উপর নিলয়ের কোন খবর নেই। সব মিলিয়ে হানিফ সাহেব বড়ই অস্থির। দিন তিনেক পর গভীর রাতে ফোন বেজে উঠলো। হানিফ সাহেব সাথে সাথে উঠে গিয়ে ফোন ধরলেন। -হ্যালো আব্বু! ওপাশ থেকে খুব দুর্বল কণ্ঠে বলে নিলয়। অজানা আশংকায় হানিফ সাহেবের গলার কেঁপে উঠে। তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন- -কি হয়েছে তোর বেটা! -আব্বু জানো, আমার না খুব জ্বর। অনেক দিন থেকে জ্বর। আমি কিচ্ছু খেতে পারিনা। খেলেই বমি হয়ে যায়। স্কুলে যেতে পারিনা। তোমাকে খুব miss করছিতো তাই অনেক কষ্ট করে লুকিয়ে ফোন করতে এসেছি। হানিফ সাহেবের বুক ব্যথায় কাতর হয়ে যায়। তার নিজেকে অসম্ভব অসহায়, অথর্ব মনে হয়। নিলয়ের কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে তার। তিনি কিছুই করতে না পেরে ফোন ধরে ছটফট করতে থাকেন। -ওষুধ খেয়েছিস বাবা! ডাক্তার দেখাসনি? -খেয়েছি আব্বু তাও বমি পায়, আমার খুব তোমার কাছে চলে আসতে ইচ্ছে করে। দুর্বল কণ্ঠে বলে নিলয়। -তোকে আমার কাছে নিয়ে আসব বেটা। হানিফ সাহেবের চোখ ভিজে আসে কথা বলতে বলতে। -আব্বু, তোমাকে একটা surprise দেই? তোমার favorite poem টা আমি একটু পারি। তোমার কাছ থেকে শুনে শুনে শিখেছি। শুনো... “Shall I compare thee to a summers day… So long as men can breathe, or eyes can see, So long lives this, and this gives life to thee…. নিলয় ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে আবৃত্তি করে যাচ্ছে। ফোনের ওপাশে হানিফ সাহেবের চোখ থেকে টপ টপ করে অশ্রু পড়ছে... শেষ কথা:- সেই রাতের পরের দিন হানিফ সাহেব আবিষ্কার করলেন দীর্ঘদিন বিল না পরিশোধ করার কারণে ল্যান্ডফোনটির কানেকশন কেটে দেওয়া হয়েছে। তিনি তৎক্ষণাৎ তার বেশ কিছু শেয়ার লসে বিক্রি করে দুই দিনের মাথায় ল্যান্ডফোনটি ঠিক করেন। ল্যান্ডফোনটি এখন গেস্ট রুমেই থাকে কিন্তু নিলয় আর ফোন করেনি। বাসার সবাই হানিফ সাহেবের আচরণে বিস্মিত। রুমকির মা আজকাল মাঝে মাঝেই নিজে থেকে হানিফ সাহেবের সাথে এটা ওটা নিয়ে কথা বলতে আসেন। হানিফ সাহেব কথা বলতে উৎসাহ দেখান না। তার সময় কাটে নিলয়ের একটা ফোনের অপেক্ষায়... প্রোগ্রেসিভ ইন্টঃ স্কুলের কেজি ক্লাসের জুপিটার সেকশনে নিলয় নামের কোন ছেলেকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। হানিফ সাহেব এখনো হাল ছাড়ছেন না। প্রতিদিন সকাল ৭.৩০ থেকে দুপুর ১২.৩০ পর্যন্ত তিনি প্লে ষ্টেশনের সিডি আর স্পাইডারম্যানের ছবিওয়ালা টি-শার্ট নিয়ে স্কুলের সামনে অপেক্ষা করেন। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা সারি বেঁধে ট্রেনের মত করে স্কুল গেইট দিয়ে স্কুলে ঢুকে। আর একইভাবে ছুটির সময় বের হয়। এই ট্রেনের একজন যাত্রীর জন্যে অপেক্ষা করে হানিফ সাহেবের দিন কাটে। ঝড়বৃষ্টি যত যাই হোক হানিফ সাহেব স্কুলের সামনে চলে আসেন। তিনি কিছুতেই ট্রেন মিস করে তার সেই কাঙ্ক্ষিত যাত্রীটিকে হারাতে চান না। (উৎসর্গ- গল্পের জাদুকর ও অনুপ্রেরণার আরেক নাম যার, তিনি তো কেবল একজনই প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ ) -রিপোস্ট-
Posted on: Fri, 18 Jul 2014 18:37:48 +0000

Recently Viewed Topics




© 2015