একটু কষ্ট করে একবার চোখ - TopicsExpress



          

একটু কষ্ট করে একবার চোখ বুলান.........। আজ শেখ কামালের জন্মদিন শেষ হওয়ার আর কিছু সময় বাকি ।এই অল্প সময়টায় একটা গুরুত্বপূর্ণ ডকু প্রচার ও জানার আছে। শেখ কামাল হচ্ছেন এমন একজন যাকে অপপ্রচারের সবচেয়ে বেশী ক্ষত বিক্ষত হতে হয়েছে। তার নামে বিখ্যাত অপপ্রচার গুলোকে খন্ডিয়ে দেওয়া হয়েছে। মিথ্যাচার / অপপ্রচার-১ ‘শেখ কামাল ব্যাংক ডাকাত’ লসএঞ্জেলেস থেকে এনা (সন ২০০৫) || দীর্ঘ ৩৩ বছর আগের ঘটনা। কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ না থাকা সত্বেও একটি গুজব রয়েছে যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে শেখ কামাল নাকি ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মাঝে এ ঘটনার নিষ্পত্তি না হলেও ঘটনার ৩৩ বছর পর উপস্থাপিত হয় প্রকৃত সত্য। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক অবাক করার মতো ঘটনার একটি শেখ কামালের ব্যাংক ডাকাতি প্রসঙ্গে সবিস্তারে বার্তা সংস্থা এনাকে বলেছেন সেই রাতে শেখ কামালের সঙ্গে থাকা এবং বর্তমানে সপরিবারে আমেরিকায় বসবাসরত আবুল ফজল মোহাম্মদ আব্দুল হান্নান। লসএঞ্জেলেস প্রবাসী হান্নান বহুল বিতর্কিত ঘটনাটির ব্যাপারে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছিলেন না, আবার এমন একটি বিষয় সম্পর্কে দেশবাসীকে না জানালেও তিনি শান্তি পাচ্ছিলেন না, এমন দ্বন্দ্ব তাঁর হ্নদয়কে কুরে কুরে খাচ্ছিলো। অবশেষে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্য জনাব নাসির উদ্দিন পিন্টুর বক্তব্য তাঁর নীরবতা ভাঙ্গতে সহায়ক হয়েছে। আব্দুল হান্নান শেখ কামালের বাল্যবন্ধু এবং সর্বক্ষণিক ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের অন্যতম ছিলেন আমৃত্যু। হান্নান বলেন, ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাত প্রায় ১১ টা। পরদিন বিজয় দিবস এবং সেটি ছিলো স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বিজয় বার্ষিকী। তাই সারারাত বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী সংগঠনের ব্যাপক প্রস্তুতি চলছিলো। সদ্য স্বাধীন একটি দেশের রাজধানী হিসেবে ঢাকা যেন আনন্দে নাচছিলো। মনে হচ্ছিলো যেন ঈদের আনন্দে বিজয়ের উৎসব আসছে আর ক’ঘন্টা পরই। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও বেশ চাঙ্গা ছিলেন। তিনি বলেন, এখানে স্মরণ রাখা দরকার যে, সে সময় পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে দেশব্যাপী সন্ত্রাসী তৎপরতা চলছিলো। তিনি বলেন, সে সময় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিপক্ষ ছিলো জাসদ। তিনি আরও বলেন সিরাজ সিকদার বিজয় দিবস মানতেন না। তিনি মনে করতেন দেশের পূর্ণাঙ্গ বিজয় হয়নি। অতএব, কীসের বিজয় দিবস? সে ধারণার বশবর্তী হয়েই ওরা (সর্বহারারা) ১৪ ডিসেম্বর ঢাকায় দু’টি বোমা মেরেছিলো। এর একটি বাংলার বাণী (অধুনালুপ্ত দৈনিক এবং মালিক ছিলেন শেখ কামালের ফুফাত ভাই শেখ মণি) অফিসে এবং অপরটি বিস্ফোরিত হয় ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স অফিসে। বোমা দু’টি একটি লাল টয়োটা গাড়ি থেকে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলো বলে খবরে প্রকাশিত হয়। জনাব হান্নান বলেন, শেখ কামালের নিজস্ব কোন গাড়ি দূরের কথা ভ্যানও ছিলো না। বেক্সিমকোর বড় একটি ভ্যান ব্যবহার করতেন বন্ধুদের নিয়ে চলাফেরা এবং আড্ডার জন্য। ঠিক তেমনিভাবে সেই রাতেও ঢাকা কলেজের বিপরীতে ২৫ নম্বর ছাত্রলীগ অফিস থেকে বেক্সিমকোর বড় ভ্যানে ১০ বন্ধু চেপে বসেন। সঙ্গে ছিলেন আরও ৫ জন। কিন্তু একই ভ্যানে জায়গা না হওয়ায় আরেকটি জীপ নেয়া হয়। সেটি ছিলো রেজাউলের (কামালের বন্ধু) পারিবারিক গাড়ি। ভ্যানকে অনুসরণ করে জীপটি। ছাত্রলীগ অফিস থেকে উভয় গাড়ি যাত্রা শুরু করে মোহাম্মদপুরের দিকে। সাদা ভ্যানটি ড্রাইভ করছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ছাত্র শাহান চৌধুরী (বর্তমানে (২০০৫ সালের) আমেরিকায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শমসের মবিন চৌধুরীর ছোটভাই), তাঁর পাশে অর্থাৎ সামনের সারির মধ্যখানে বসেছিলেন ঢাবি সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্র কাজী আনোয়ারুল হক তারেক (সম্প্রতি ইন্তেকাল করেছেন এবং গত বছর আবহনীর যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন), সর্বডানে বসেছিলেন ঢাবির সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্র শেখ কামাল। দ্বিতীয় সারিতে বসেছিলেন (ড্রাইভার সিটের পেছনে, বাম থেকে) ঢাবির সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্র আমি নিজে, মাঝখানে সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্র, কিছু কাল জার্মানিতে ছিলেন এবং বর্তমানে শুল্ক বিভাগের সুপারিনটেডেন্ট রুহুল আমিন খোকা, ডানে বসেছিলেন ঢাবির পলিটিক্যাল সায়েন্সের ছাত্র মুনির (কানাডা প্রবাসী), তৃতীয় সারিতে (বাম থেকে) ঢাবির সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্র ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু (বর্তমানে (২০০৫) কৃষি প্রতিমন্ত্রী), মাঝখানে বরকত- ই খোদা (তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন না তবে শেখ কামালের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিলো এবং প্রায় সময় একত্রে আড্ডা দিতেন, বর্তমানে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের জেনারেল ম্যানেজার) এবং ডানে ছিলেন চুয়াডাঙ্গার সন্তান কাজী সিরাজ। ভ্যানে সিট ছিলো ৯টি। এজন্য খোকা নামক আরেকজন আকারে ছোটখাটো ছিলেন বিধায় লাফ দিয়ে পেছনের লাগেজ স্পেসে বসেছিলেন। অপর গাড়িতে ছিলেন ঢাবির সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র এবং বর্তমানে ব্যবসায়ী রেজাউল করিম, শাহেদ রেজা (বর্তমানে আঃ লীগ নেতা), শেখ রফিক (বর্তমানে ব্যবসায়ী), আক্কাস (বর্তমানে ব্যবসায়ী) এবং মন্টু (যিনি ইন্তেকাল করেছেন)। জনাব হান্নান বলেন, ভ্যানটি মোহাম্মদপুর হয়ে মিরপুর দিয়ে ঘুরে সংসদ ভবনের পাশ দিয়ে ফার্মগেট থেকে বাংলা মোটর প্রদক্ষিণ করছে। সে সময় শীতকাল ছিলো। ট্রাফিকও হালকা ছিলো। দোকানপাটও বন্ধ। ভ্যানভর্তি বন্ধুরা হৈহুল্লুড় করতে করতে মালিবাগ, রাজারবাগ হয়ে টিএ্যান্ডটি কলেজের সামনে দিয়ে ইত্তেফাক অফিসের দিকে চলছিলো। পরিকল্পনা ছিলো গুলিস্থান হয়ে আবার ছাত্রলীগ অফিসে ফিরে যাওয়ার। ভ্যান এগুচ্ছিলো শাপলা চত্বরের দিকে। এমনি অবস্থায় ভ্যান থেকে কয়েকজন দেখেন যে বিপরীত দিক থেকে একটি লাল গাড়ি তাদের অতিক্রম করে চলে গেল। সে গাড়িতে কয়েকজন মুখ ঢাকা। ভ্যানের বন্ধুরা ভাবল হয়ত সিরাজ সিকদারের লোক হবে। সঙ্গে সঙ্গে ভ্যান ইউ টার্ন করে ঘুরিয়ে ঐ লাল গাড়িকে অনুসরণ করল। তাঁরা ধারণা করেছিলেন, পরদিনের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানকে বানচালের নতুন কোন ষড়যন্ত্র করেছে। কেননা আগের রাতেও ওরা বোমাবাজি করে জনজীবনকে সন্ত্রস্ত করেছে। গাড়িটির গতিরোধ করা হয়। দেখা গেল সেটি টয়োটা নয়। ঐ গাড়ির যাত্রীরা বললেন যে কাজ শেষে ঘরে ফিরছেন। শীতের কারণে মাফলার দিয়ে মুখ ঢাকা হয়েছে। ওরা চলে গেল। এমন সময় টুকু দেখতে পান যে নিকটেই আল হেলাল হোটলের সামনে লাল রঙ্গের একটি টয়োটা গাড়ি। সে গাড়িটি তাদের লক্ষ্য করছে। জনাব হান্নান বলেন, এ অবস্থায় আমাদের বহনকারী ভ্যানটি ধীরে ধীরে ঐ গাড়ির দিকে এগুতে থাকে। এ সময় লাল টয়োটা সামনের দিকে চলতে থাকে। টয়োটা ক্রমশ স্পীড বাড়িয়ে দিল ভ্যানকে আড়ালে রেখে অন্যত্র যাবার মতলবে। টয়োটা এগুচ্ছে কমলাপুর হয়ে কবি জসীমউদ্দীন রোড দিয়ে ছোট্ট ব্রিজ পার হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের দিকে। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশেই মুসলিম লীগের প্রান্তন এমএনএ ওবায়দ্জ্জুামানের বাসা ছিলো। স্বাধীনতার পর সরকার সেটি দখল করে নেয় এবং সে বাড়িতে স্পেশাল ব্রাঞ্চের ২ নম্বর ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়। টয়োটা স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসের দিকে যাচ্ছিলো। পরে জানা গেছে, টয়োটায় ছিলেন সার্জেন্ট শামীম কিবরিয়া। তিনি ফাঁড়িতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে সকল আলো নিভিয়ে দেয়া হয় এবং সকলকে পজিশন নিতে নির্দেশ দেন ওয়াকিটকির মাধ্যমে। সঙ্গে সঙ্গে স্পেশাল ব্রাঞ্চের সশস্ত্র লোকজন বাড়িটির ছাদে ও বিভিন্ন অবস্থানে যান এবং টয়োটা একেবারে অফিসের ভেতরে ঢোকে। টয়োটাকে অনুসরণ করে ভ্যানটিও ভেতরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে টয়োটার স্টার্ট বন্ধ করা হয় এবং মুহূর্তে এলাকাটি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোকজন অবিরতভাবে গুলি চালায়। ছাদের উপর থেকে থ্রী নট থ্রী’র গুলি ভ্যানের ছাদ ভেধ করে ভেতরে ঢোকে এবং কয়েকটি গুলি শেখ কামালের বাম পাশের কলারে লাগে। ৪টি গুলি কলার বোনের ভেতরে ঢোকে। ভ্যানের আরও ৫জন গুলিবিদ্ধ হয়। একজনের হাতের ৪টি আঙ্গুল উড়ে যায়। কারোর পিঠে গুলি লাগে। একজনের পায়ে এবং আরেকজনের ঠোঁটে লাগে গুলি। সৌভাগ্যক্রমে আমি, রুহুল, খোকা এবং টুকু গুলি থেকে বেঁচে যাই। জনাব হান্নান বলেন, মুসলিম লীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মামুনের ছেলে টুকু বৃষ্টির মতো গুলি বর্ষণের সময় চিৎকার করে বলেন যে এটা স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিস। সঙ্গে সঙ্গে শেখ কামাল আরো জোরে চিৎকার করে বলতে থাকেন ‘আমি শেখ কামাল’। এ কথা শুনে সার্জেন্ট গুলি বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েই দৌড়ে ভ্যানের কাছে আসেন এবং ভয়ে কান্নাকাটি শুরু করেন। সার্জেন্ট বলেন, আমাদের ভুল হয়েছে। আমি বুঝতে পারিনি, আমাকে মাফ করে দিন। এমনি অবস্থায় রেজাউল আহতদের জীপে তুলে সোজা চলে যান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে। তাৎক্ষণিকভাবে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শেখ কামালের দেহ থেকে ৩টি বুলেট বের করা সম্ভব হয়। অপর বুলেটটি পরবর্তীতে মস্কো থেকে অপসারণ করে আনা হয়েছিলো। জনাব হান্নান বলেন, আমাদের ভ্যানটিতে কোন অস্ত্র পাওয়া যায়নি বলে সে সময়কার মিডিয়াসহ প্রশাসন অবহিত করেছিলো। ভোররাত পর্যন্ত হাসপাতালে আহতদের নিয়ে চিকিৎসক এবং আহদের পরিবাবর্গ মহা টেনশনে ছিলো। সকালে বিজয় দিবসের মহাসমাবেশে জাসদের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয় যে, শেখ কামাল দলবল নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। সারাদেশে খবরটি বাতাসের চেয়েও দ্রুত বেগে ছড়িয়ে পড়ে। জনাব হান্নান বলেন, সেই থেকে ঘটনাটি রহস্যাবৃত্তই রয়ে গেছে। আজ অবধি কেউ সে ঘটনার পক্ষে বা বিপক্ষে কোন আলামত-প্রমাণাদি উপস্থাপন করেননি। আমি তাই বাধ্য হলাম ঐতিহাসিক একটি মিথ্যাকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার জন্য। কেননা ঐ ভ্যানে শেখ কামালের সঙ্গে যাঁরা ছিলাম তাঁদের অনেকেই বিভিন্ন স্তরে রয়েছি। রাজনৈতিকভাবে পরস্পরের বিপক্ষে অবস্থান করলেও অন্তত ঐ ব্যাপারে কেউ সত্যকে আড়াল করতে চাইবেন না। কেননা শেখ কামালের মতো বিশ্বস্ত বন্ধু আমরা আর কখনও পাইনি। মিথ্যাচার / অপপ্রচার-২ ডালিমের স্ত্রীর অপহরনকারীঃ- মেজর ডালিম (পরে লে. কর্নেল) এর লিখিত গ্রন্থ যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি( লিংক majordalimbubangla/71.html) এর সুত্র মতে, ঘটনার সাথে শেখ কামাল জড়িত নন । এখানে তার বই থেকে ঘটনা তুলে দেয়া হলো : রেডক্রস চেয়ারম্যান এবং তদানীন্তন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ প্রধান গাজী গোলাম মোস্তফা নিম্মী এবং আমাকে বন্দুকের মুখে লেডিস ক্লাব থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি ঘটে এক বর্বরোচিত অকল্পনীয় ঘটনা। দুস্কৃতিকারী দমন অভিযানে সেনাবাহিনী তখনও সারাদেশে নিয়োজিত। আমার খালাতো বোন তাহ্‌মিনার বিয়ে ঠিক হল কর্নেল রেজার সাথে। দু’পক্ষই আমার বিশেষ ঘনিষ্ট। তাই সব ব্যাপারে মধ্যস্থতা করতে হচ্ছিল আমাকে এবং নিম্মীকেই। বিয়ের দু’দিন আগে ঢাকায় এলাম কুমিল্লা থেকে। ঢাকা লেডিস ক্লাবে বিয়ের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। সেই বিয়েতে অনেক গন্যমান্য সামরিক এবং বেসামরিক লোকজন বিশেষ করে হোমরা-চোমরারা এসেছিলেন অতিথি হিসেবে। পুরো অনুষ্ঠানটাই তদারক করতে হচ্ছিল নিম্মী এবং আমাকেই। আমার শ্যালক বাপ্পি ছুটিতে এসেছে ক্যানাডা থেকে। বিয়েতে সেও উপস্থিত। বিয়ের কাজ সুষ্ঠভাবেই এগিয়ে চলেছে। রেডক্রস চেয়ারম্যান গাজী গোলাম মোস্তফার পরিবারও উপস্থিত রয়েছেন অভ্যাগতদের মধ্যে। বাইরের হলে পুরুষদের বসার জায়গায় বাপ্পি বসেছিল। তার ঠিক পেছনের সারিতে বসেছিল গাজীর ছেলেরা। বয়সে ওরা সবাই কমবয়সী ছেলে-ছোকরা। বাপ্পি প্রায় আমার সমবয়সী। হঠাৎ করে গাজীর ছেলেরা পেছন থেকে কৌতুকচ্ছলে বাপ্পির মাথার চুল টানে, বাপ্পি পেছনে তাকালে ওরা নির্বাক বসে থাকে। এভাবে দু’/তিনবার চুলে টান পড়ার পর বাপ্পি রাগান্বিত হয়ে ওদের জিজ্ঞেস করে, -চুল টানছে কে? -আমরা পরখ করে দেখছিলাম আপনার চুল আসল না পরচুলা। জবাব দিল একজন। পুচঁকে ছেলেদের রসিকতায় বাপ্পি যুক্তিসঙ্গত কারণেই ভীষণ ক্ষেপে যায়; কিন্তু কিছুই বলে না। মাথা ঘুরিয়ে নিতেই আবার চুলে টান পরে। এবার বাপ্পি যে ছেলেটি চুলে টান দিয়েছিল তাকে ধরে ঘর থেকে বের করে দিয়ে বলে, -বেয়াদপ ছেলে মশকারী করার জায়গা পাওনি? খবরদার তুমি আর ঐ জায়গায় বসতে পারবে না। এ কথার পর বাপ্পি আবার তার জায়গায় ফিরে আসে। এ ঘটনার কিছুই আমি জানতাম না। কারণ তখন আমি বিয়ের তদারকি এবং অতিথিদের নিয়ে ভীষণভাবে ব্যস্ত। বিয়ের আনুষ্ঠিকতার প্রায় সবকিছুই সুষ্ঠভাবেই হয়ে যায়। খাওয়া-দাওয়ার পর্বও শেষ। অতিথিরা সব ফিরে যাচ্ছেন। সেদিন আবার টেলিভিশনে সত্যজিৎ রায়ের পুরষ্কার প্রাপ্ত ছবি ‘মহানগর’ ছবিটি দেখানোর কথা; তাই অনেকেই তাড়াতাড়ি ফিরে যাচ্ছেন ছবিটি দেখার জন্য। অল্প সময়ের মধ্যেই লেডিস ক্লাব প্রায় ফাঁকা হয়ে গেল। মাহবুবের আসার কথা। মানে এসপি মাহবুব। আমাদের বিশেষ ঘনিষ্ট বন্ধুদের একজন। আমরা সব একইসাথে যুদ্ধ করেছি স্বাধীনতা সংগ্রামে। কি এক কাজে মানিকগঞ্জ যেতে হয়েছিল তাকে। ওখান থেকে খবর পাঠিয়েছে তার ফিরতে একটু দেরী হবে। ঘনিষ্ট আত্মীয়-স্বজনরা সবেমাত্র তখন খেতে বসেছি। হঠাৎ দু’টো মাইক্রোবাস এবং একটা কার এসে ঢুকল লেডিস ক্লাবে। কার থেকে নামলেন স্বয়ং গাজী গোলাম মোস্তফা আর মাইক্রোবাস দু’টো থেকে নামল প্রায় ১০-১২ জন অস্ত্রধারী বেসামরিক ব্যক্তি। গাড়ি থেকেই প্রায় চিৎকার করতে করতে বেরুলেন গাজী গোলাম মোস্তফা। -কোথায় মেজর ডালিম? বেশি বার বেড়েছে। তাকে আজ আমি শায়েস্তা করব। কোথায় সে? আমি তখন ভেতরে সবার সাথে খাচ্ছিলাম। কে যেন এসে বলল গাজী এসেছে। আমাকে তিনি খুঁজছেন। হঠাৎ করে গাজী এসেছেন কি ব্যাপার? ভাবলাম বোধ হয় তার পরিবারকে নিয়ে যেতে এসেছেন তিনি। আমি তাকে অর্ভ্যথনা করার জন্য বাইরে এলাম। বারান্দায় আসতেই ৬-৭জন স্টেনগানধারী আমার বুকে-পিঠে-মাথায় তাদের অস্ত্র ঠেকিয়ে ঘিরে দাড়াল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমিতো হতবাক! কিছুটা অপ্রস্তুতও বটে। সামনে এসে দাড়ালেন স্বয়ং গাজী। আমি অত্যন্ত ভদ্রভাবে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, -ব্যাপার কি? এ সমস্ত কিছুর মানেই বা কি? তিনি তখন ভীষণভাবে ক্ষীপ্ত। একনাগাড়ে শুধু বলে চলেছেন, -গাজীরে চেন না। আমি বঙ্গবন্ধু না। চল্‌ শালারে লইয়া চল্‌। আইজ আমি তোরে মজা দেখামু। তুই নিজেরে কি মনে করছস? অশালীনভাবে কথা বলছিলেন তিনি। আমি প্রশ্ন করলাম, -কোথায় কেন নিয়ে যাবেন আমাকে? আমার প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে তিনি নির্দেশ দিলেন তার অস্ত্রধারী অনুচরদের। তার ইশারায় অস্ত্রধারীরা সবাই তখন আমাকে টানা-হেচড়া করে মাইক্রোবাসের দিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। বিয়ের উপলক্ষ্যে নিরাপত্তার জন্য পুলিশের বন্দোবস্ত করা হয়েছে; গাড়িতে আমার এস্কট সিপাইরাও রয়েছে। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কি করা উচিত। একটা বিয়ের অনুষ্ঠান। কন্যা দান তখনও করা হয়নি। কি কারণে যে এমন অদ্ভুত একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হল সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ দেখলাম বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা আলম এবং চুল্লুকে মারতে মারতে একটা মাইক্রোবাসে উঠালো ৩-৪ জন অস্ত্রধারী। ইতিমধ্যে বাইরে হৈ চৈ শুনে নিম্মী এবং খালাম্মা মানে তাহমিনার আম্মা বেরিয়ে এসেছেন অন্দরমহল থেকে। খালাম্মা ছুটে এসে গাজীকে বললেন, -ভাই সাহেব একি করছেন আপনি? ওকে কেন অপদস্ত করছেন? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন ওকে? কি দোষ করেছে ও? গাজী তার কোন কথারই জবাব দিলেন না। তার হুকুমের তামিল হল। আমাকে জোর করে ঠেলে উঠান হল মাইক্রোবাসে। বাসে উঠে দেখি আলম ও চুল্লু দু’জনেই গুরুতরভাবে আহত। ওদের মাথা এবং মুখ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। আমাকে গাড়িতে তুলতেই খালাম্মা এবং নিম্মী দু’জনেই গাজীকে বলল, -ওদের সাথে আমাদেরকেও নিতে হবে আপনাকে। ওদের একা নিয়ে যেতে দেব না আমরা। -ঠিক আছে; তবে তাই হবে। বললেন গাজী। গাজীর ইশারায় ওদেরকেও ধাক্কা দিয়ে উঠান হল মাইক্রোবাসে। বেচারী খালাম্মা! বয়স্কা মহিলা, আচমকা ধাক্কায় হুমড়ি খেয়ে পড়লেন মাইক্রোবাসের ভিতরে। আমার দিকে অস্ত্রতাক করে দাড়িয়ে থাকলো পাঁচজন অস্ত্রধারী; গাজীর সন্ত্রাস বাহিনীর মাস্তান। গাজী গিয়ে উঠল তার কারে। বাকি মাস্তানদের নিয়ে দ্বিতীয় মাইক্রোবাসটা কোথায় যেন চলে গেল। মাইক্রোবাস দুইটি ছিল সাদা রং এর এবং তাদের গায়ে ছিল রেডক্রসের চিহ্ন আঁকা। গাজীর গাড়ি চললো আগে আগে আর আমাদের বহনকারী মাইক্রোবাসটি চললো তার পেছনে। এসমস্ত ঘটনা যখন ঘটছিল তখন আমার ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা কামরুল হক স্বপন বীর বিক্রম ও বাপ্পি লেডিস ক্লাবে উপস্থিত ছিল না। তারা গিয়েছিল কোন এক অতিথিকে ড্রপ করতে। আমাদের কাফেলা লেডিস কা্লব থেকে বেরিয়ে যাবার পর ওরা ফিরে এসে সমস্ত ঘটনা জানতে পারে লিটুর মুখে। সবকিছু জানার পরমুহুর্তেই ওরা যোগাযোগ করল রেসকোর্সে আর্মি কন্ট্রোল রুমে তারপর ক্যান্টনমেন্টের এমপি ইউনিটে। ঢাকা ব্রিগেড মেসেও খবরটা পৌঁছে দিল স্বপন। তারপর সে বেরিয়ে গেল ঢাকা শহরের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ করে আমাদের খুঁজে বের করার জন্য। আবুল খায়ের লিটু আমার ছোট বোন মহুয়ার স্বামী এবং আমার বন্ধু। ও ছুটে গেল এসপি মাহবুবের বাসায় বেইলী রোডে। উদ্দেশ্য মাহবুবের সাহায্যে গাজীকে খুঁজে বের করা। এদিকে আমাদের কাফেলা গিয়ে থামল রমনা থানায়। গাজী তার গাড়ি থেকে নেমে চলে গেল থানার ভিতরে। অল্প কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে নিজের গাড়িতে উঠে বসলেন গাজী। কাফেলা আবার চলতে শুরু করল। কাফেলা এবার চলছে সেকেন্ড ক্যাপিটালের দিকে। ইতিমধ্যে নিম্মী তার শাড়ী ছিড়ে চুল্লু ও আলমের রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য ব্যান্ডেজ বেধে দিয়েছে। সেকেন্ড ক্যাপিটালের দিকে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে দেখে আমি চিন্তিত হয়ে পড়লাম। গাজীর মনে কোন দুরভিসন্ধি নেইতো? রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে হত্যা করবে নাতো? ওর পক্ষে সবকিছুই করা সম্ভব। কিছু একটা করা উচিত। হঠাৎ আমি বলে উঠলাম, -গাড়ি থামাও! আমার বলার ধরণে ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে দিল। আমাদের গাড়িটা থেমে পড়ায় সামনের গাজীর গাড়িটাও থেমে পড়ল। আমি তখন অস্ত্রধারী একজনকে লক্ষ্য করে বললাম গাজী সাহেবকে ডেকে আনতে। সে আমার কথার পর গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে গাজীকে গিয়ে কিছু বলল। দেখলাম গাজী নেমে আসছে। কাছে এলে আমি তাকে বললাম, -গাজী সাহেব আপনি আমাদের নিয়ে যাই চিন্তা করে থাকেন না কেন; লেডিস ক্লাব থেকে আমাদের উঠিয়ে আনতে কিন্তু সবাই আপনাকে দেখেছে। তাই কোন কিছু করে সেটাকে বেমালুম হজম করে যাওয়া আপনার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হবে না। আমার কথা শুনে কি যেন ভেবে নিয়ে তিনি আবার তার গাড়িতে গিয়ে উঠলেন। কাফেলা আবার চলা শুরু করল। তবে এবার রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পের দিকে নয়, গাড়ি ঘুরিয়ে তিনি চললেন ৩২নং ধানমন্ডি প্রধানমন্ত্রীর বাসার দিকে। আমরা হাফ ছেড়ে বাচলাম। কলাবাগান দিয়ে ৩২নং রোডে ঢুকে আমাদের মাইক্রোবাসটা শেখ সাহেবের বাসার গেট থেকে একটু দূরে এলকটা গাছের ছায়ায় থামতে ইশারা করে জনাব গাজী তার গাড়ি নিয়ে সোজা গেট দিয়ে ঢুকে গেলেন ৩২নং এর ভিতরে। সেকেন্ড ফিল্ড রেজিমেন্ট তখন শেখ সাহেবের বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। একবার ভাবলাম ওদের ডাকি, আবার ভাবলাম এর ফলে যদি গোলাগুলি শুরু হয়ে যায় তবে ক্রস-ফায়ারে বিপদের ঝুঁকি বেশি। এ সমস্তই চিন্তা করছিলাম হঠাৎ দেখি লিটুর ঢাকা ক-৩১৫ সাদা টয়োটা কারটা পাশ দিয়ে হুস্‌ করে এগিয়ে গিয়ে শেখ সাহেবের বাসার গেটে গিয়ে থামল। লিটুই চালাচ্ছিল গাড়ি। গাড়ি থেকে নামল এসপি মাহবুব। নেমেই প্রায় দৌড়ে ভিতরে চলে গেল সে। লিটু একটু এগিয়ে গিয়ে রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষায় রইলো সম্ভবত মাহ্বুবের ফিরে আসার প্রতীক্ষায়। লিটু এবং মাহ্বুবকে দেখে আমরা সবাই আস্বস্ত হলাম। র্নিঘাত বিপদের হাত থেকে পরম করুণাময় আল্লাহ্‌’তায়ালা আমাদের বাচিঁয়ে দিলেন। লিটু যখন মাহ্‌বুবের বাসায় গিয়ে পৌঁছে মাহবুব তখন মানিকগঞ্জ থেকে সবেমাত্র ফিরে বিয়েতে আসার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। হঠাৎ লিটুকে হন্তদন্ত হয়ে উপরে আসতে দেখে তার দিকে চাইতেই লিটু বলে উঠল, -মাহ্বুব ভাই সর্বনাশ হয়ে গেছে। বিয়ে বাড়ি থেকে গাজী বিনা কারণে ডালিম-নিম্মীকে জবরদস্তি গান পয়েন্টে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। একথা শুনে মাহবুব স্তম্ভিত হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রীকেই খবরটা সবচেয়ে আগে দেওয়া দরকার কোন অঘটন ঘটে যাবার আগে। গাজীর কোন বিশ্বাস নাই; ওর দ্বারা সবকিছুই সম্ভব। মাহবুব টেলিফোনের দিকে এগিয়ে যায়। হঠাৎ টেলিফোনটাই বেজে উঠে। রেড টেলিফোন। মাহবুব ত্রস্তে উঠিয়ে নেয় রিসিভার। প্রধানমন্ত্রী অপর প্রান্তে, -মাহবুব তুই জলদি চলে আয় আমার বাসায়। গাজী এক মেজর আর তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের ধইরা আনছে এক বিয়ার অনুষ্ঠান থ্যাইকা। ঐ মেজর গাজীর বউ-এর সাথে ইয়ার্কি মারার চেষ্টা করছিল। উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে। বেশি বাড় বাড়ছে সেনাবাহিনীর অফিসারগুলির। সব শুনে মাহবুব জানতে চাইলো, -স্যার গাজী সাহেবকে জিজ্ঞেস করুন মেজর ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের কোথায় রেখেছেন তিনি? -ওদের সাথে কইরা লইয়া আইছে গাজী। গেইটের বাইরেই গাড়িতে রাখা হইছে বদমাইশগুলারে। জানালেন প্রধানমন্ত্রী। -স্যার গাজী সাহেব ডালিম আর নিম্মীকেই তুলে এনেছে লেডিস ক্লাব থেকে। ওখানে ডালিমের খালাতো বোনের বিয়ে হচ্ছিল আজ। জানাল মাহবুব। -কছ কি তুই! প্রধানমন্ত্রী অবাক হলেন। -আমি সত্যিই বলছি স্যার। আপনি ওদের খবর নেন আমি এক্ষুণি আসছি। এই কথোপকথনের পরই মাহবুব লিটুকে সঙ্গে করে চলে আসে ৩২নং ধানমন্ডিতে। মাহ্‌বুবের ভিতরে যাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই রেহানা, কামাল ছুটে বাইরে এসে আমাদের ভিতরে নিয়ে যায়। আলম ও চুল্লুর রক্তক্ষরণ দেখে শেখ সাহেব ও অন্যান্য সবাই শংকিত হয়ে উঠেন। -হারামজাদা, এইডা কি করছস তুই? গাজীকে উদ্দেশ্য করে গর্জে উঠলেন শেখ মুজিব। চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে নিম্মী এবং আমাকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। খালাম্মা ঠিকমত হাটতে পারছিলেন না। কামাল, রেহানা ওরা সবাই ধরাধরি করে ওদের উপরে নিয়ে গেল। শেখ সাহেবের কামরায় তখন আমি, নিম্মী আর গাজী ছাড়া অন্য কেউ ছিল না। নিম্মী দুঃখে-গ্ল্যানিতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। শেখ সাহেব ওকে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দিতে চেষ্টা করছিলেন। অদূরে গাজী ভেজা বেড়ালের মত কুকড়ে দাড়িয়ে কাঁপছিল। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। রেড ফোন। শেখ সাহেব নিজেই তুলে নিলেন রিসিভার। গাজীর বাসা থেকে ফোন এসেছে। বাসা থেকে খবর দিল আর্মি গাজীর বাসা রেইড করে সবাইকে ধরে নিয়ে গেছে। শুধু তাই নয় সমস্ত শহরে আর্মি চেকপোষ্ট বসিয়ে প্রতিটি গাড়ি চেক করছে। ক্যান্টনমেন্ট থেকে কিডন্যাপিং এর খবর পাওয়ার পরপরই ইয়ং-অফিসাররা যে যেখনেই ছিল সবাই বেরিয়ে পড়েছে এবং খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে মেজর ডালিম ও তার স্ত্রী নিম্মীকে। সমস্ত শহরে হৈচৈ পড়ে গেছে। গাজীরও কোন খবর নেই। গাজীকে এবং তার অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদেরও খুঁজছে আর্মি তন্নতন্ন করে সম্ভাব্য সব জায়গায়। টেলিফোন পাওয়ার পর শেখ সাহেবের মুখটা কালো হয়ে গেল। ফোন পেয়েই তিনি আমাদের সামনেই আর্মি চীফ শফিউল্লাহকে হটলাইনে বললেন, -ডালিম, নিম্মী, গাজী সবাই আমার এখানে আছে, তুমি জলদি চলে আসো আমার এখানে। ফোন রেখে শেখ সাহেব গাজীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, -মাফ চা নিম্মীর কাছে। গাজী শেখ সাহেবের হুকুমে নিম্মীর দিকে এক পা এগুতেই সিংহীর মত গর্জে উঠল নিম্মী, -খবরদার! তোর মত ইতর লোকের মাফ চাইবার কোন অধিকার নাই; বদমাইশ। এরপর শেখ মুজিবের দিকে ফিরে বলল নিম্মী, -কাদের রক্তের বদলে আজ আপনি প্রধানমন্ত্রী? আমি জানতে চাই। আপনি নিজেকে জাতির পিতা বলে দাবি করেন। আমি আজ আপনার কাছে বিচার চাই। আজ আমার জায়গায় শেখ হাসিনা কিংবা রেহানার যদি এমন অসম্মান হত তবে যে বিচার আপনি করতেন আমি ঠিক সেই বিচারই চাই। যাদের রক্তের বিনিময়ে আজ আপনারা জাতির কর্ণধার হয়ে ক্ষমতা ভোগ করছেন সেইসব মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ভুলুন্ঠিত করে তাদের গায়ে হাত দেয়ার মত সাহস কম্বলচোর গাজী পায় কি করে? এর উপযুক্ত জবাব আমি আজ চাই আপনার কাছ থেকে। আজ পর্যন্ত আপনি বলতে পারবেন না ব্যক্তিগতভাবে কোন কিছু চেয়েছি আপনার কাছে কিন্তু আজ দাবি করছি ন্যায্য বিচার। আপনি যদি এর বিচার না করেন তবে আমি আল্লাহ্‌র কাছে এই অন্যায়ের বিচার দিয়ে রাখলাম। তিনি নিশ্চয়ই এর বিচার করবেন। আমি অনেক চেষ্টা করেও সেদিন নিম্মীকে শান্ত করতে পারিনি। ঠান্ডা মেজাজের কোমল প্রকৃতির নিম্মীর মধ্যেও যে এধরণের আগুন লুকিয়ে থাকতে পারে সেটা আমার কাছেও আশ্চর্য লেগেছিল সেদিন। শেখ সাহেব নিম্মীর কথা শুনে ওকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলেছিলেন, -মা তুই শান্ত ’হ। হাসিনা-রেহানার মত তুইও আমার মেয়েই। আমি নিশ্চয়ই এর উপযুক্ত বিচার করব। অন্যায়! ভীষণ অন্যায় করছে গাজী কিন্তু তুই মা শান্ত ’হ। বলেই রেহানাকে ডেকে তিনি নিম্মীকে উপরে নিয়ে যেতে বললেন। রেহানা এসে নিম্মীকে উপরে নিয়ে গেল। ইতিমধ্যে জেনারেল শফিউল্লাহ এবং ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার সাফায়াত জামিল এসে পৌঁছেছে। শেখ সাহেব তাদের সবকিছু খুলে বলে জেনারেল শফিউল্লাকে অনুরোধ করলেন গাজীর পরিবারের সদস্যদের ছেড়ে দেবার বন্দোবস্ত করতে। জেনারেল শফিউল্লাহ রেসকোর্স কন্ট্রোল রুমে অপারেশন কমান্ডার মেজর মোমেনের সাথে কথা বলার জন্য টেলিফোন তুলে নিলেন, -হ্যালো মোমেন, আমি শফিউল্লাহ বলছি প্রাইম মিনিষ্টারের বাসা থেকে। ডালিম, নিম্মী, গাজী ওরা সবাই এখানেই আছে। প্রাইম মিনিষ্টারও এখানেই উপস্থিত আছেন। Everything is going to be all right. Order your troops to stand down এবং গাজী সাহেবের পরিবারের সদস্যদের ছেড়ে দাও। অপরপ্রান্ত থেকে মেজর মোমেন জেনারেল শফিউল্লাকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিলেন কিডন্যাপ করে নিয়ে যাওয়া অফিসার এবং তার স্ত্রীকে না দেখা পর্যন্ত এবং গাজী ও তার ১৭জন অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের তার হাতে সমর্পন না করা পর্যন্ত তার পক্ষে গাজীর পরিবারের কাউকেই ছাড়া সম্ভব নয়। শফিউল্লাহ তাকে অনেক বোঝাতে চেষ্টা করলেন কিন্তু মেজর মোমেন তার অবস্থানে অটল থাকলেন শফিউল্লাহর সব যুক্তিকে অসাড় প্রমাণিত করে। অবশেষে শফিউল্লাহ ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেকটা বাধ্য হয়েই প্রধানমন্ত্রীকে অপারেশন কমান্ডার এর শর্তগুলো জানালেন। শেখ সাহেবের মুখ শুকিয়ে গেল। তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন মেজর মোমেনের সাথে কথা বলতে। আমি অগত্যা টেলিফোন হাতে তুলে নিলাম, -হ্যালো স্যার। মেজর ডালিম বলছি। Things are under control প্রধানমন্ত্রী কথা দিয়েছেন তিনি ন্যায় বিচার করবেন। - Well Dalim it’s nice to hear from you. But as the Operation Commander I must have my demands met. I got to be loyal to my duty as long as the army is deployed for anti-miscreant’s drive. The identified armed miscreants cannot be allowed to go escort free. As far as I am concerned the law is equal for everyone so there can’t be any exception. Chief has got to understand this.বললেন মেজর মোমেন। - Please Sir, why don’t you comeover and judge the situation yourself. অনুরোধ জানিয়েছিলাম আমি। - There is no need for me to come. However, I am sending Capt. Feroz. বলে ফোন ছেড়ে দিলেন মেজর মোমেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই ক্যাপ্টেন ফিরোজ এসে পড়ল। ফিরোজ আমার বাল্যবন্ধু। এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরল। -তুই গাজীরে মাফ কইরা দে। আর গাজী তুই নিজে খোদ উপস্থিত থাকবি কন্যা সম্প্রদানের অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত। অনেকটা মোড়লী কায়দায় একটা আপোষরফা করার চেষ্টা করলেন প্রধানমন্ত্রী। -আমার বোনের সম্প্রদানের জন্য গাজীর বিয়ের অনুষ্ঠানে যাবার কোন প্রয়োজন নেই। ওকে মাফ করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সেটা হবে আমার জন্য নীতি বিরোধিতা। আমরা দেশ স্বাধীন করেছি রক্তের বিনিময়ে। আমাদের গা থেকে রক্ত ঝরাটা কোন বড় ব্যাপার নয়। ইউনিফর্মের চাকুরি করি টাকা-পয়সার লোভেও নয়। একজন সৈনিক হিসাবে আমার আত্মমর্যাদা এবং গৌরবকে অপমান করেছেন গাজী নেহায়েত অন্যায়ভাবে। আপনিই আমাদের দায়িত্ব দিয়েছেন জনগণের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। অবৈধ অস্ত্রধারীদের খুঁজে বের করে আইনানুযায়ী তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে। সেখানে আজ আমাদেরই ইজ্জত হারাতে হল অবৈধ অস্ত্রধারীদের হাতে! আপনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে কথা দিয়েছেন এর উচিত বিচার করবেন। আমরা আপনি কি বিচার করেন সেই অপেক্ষায় থাকব। ক্যাপ্টেন ফিরোজকে উদ্দেশ্য করে সবার সামনেই বলেছিলাম, দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন বিচারের ওয়াদা করেছেন সেক্ষেত্রে গাজীর পরিবারের সদস্যদের আর আটকে রাখার প্রয়োজন কি? কর্নেল মোমেনকে বুঝিয়ে তাদের ছেড়ে দেবার বন্দোবস্ত করিস। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসছিলাম ঠিক সেই সময় শেখ সাহেব বললেন, -আমার গাড়ি তোদের পৌঁছে দেবে। -তার প্রয়োজন হবে না চাচা। বাইরে লিটু-স্বপনরা রয়েছে তাদের সাথেই চলে যেতে পারব। বাইরে বেরিয়ে দেখি ৩২নং এর সামনের রাস্তায় গাড়ির ভীড়ে তিল ধারণের ঠাই নেই। পুলিশ অবস্থা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। বন্ধু-বান্ধবরা যারাই জানতে পেরেছে আমাদের কিডন্যাপিং এর ব্যাপারটা; তাদের অনেকেই এসে জমা হয়েছে স্বতঃস্ফুর্তভাবে। আমাদের দেখে সবাই ঘিরে ধরল। সবাই জানতে চায় কি প্রতিকার করবেন প্রধানমন্ত্রী এই জঘণ্য অপরাধের। সংক্ষেপে যতটুকু বলার ততটুকু বলে ফিরে এলাম লেডিস ক্লাবে। মাহবুবও এল সাথে। মাহবুবের উছিলায় সেদিন রক্ষা পেয়েছিলাম চরম এক বিপদের হাত থেকে আল্লাহ্‌পাকের অসীম করুণায়। বিয়ের আসরে আমরা ফিরে আসায় পরিবেশ আবার আনন্দ-উচ্ছাসে ভরে উঠল। সবাই আবার হাসি-ঠাট্টার মাধ্যমে বিয়ের বাকি আনুষ্ঠিকতা সম্পন্ন করে কন্যা সম্প্রদান করা হল। তাহমিনার বিয়ের রাতটা আওয়ামী দুঃশাসনের একটা ঐতিহাসিক সাক্ষী হয়ে থাকলো। জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে থাকলো আওয়ামী নেতাদের এবং তাদের ব্যক্তিগত বাহিনীর ন্যাক্কারজনক স্বেচ্ছাচার ও নিপীড়নের। কী করে এমন একটা জঘণ্য ঘটনার সাথে গাজী সরাসরি নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে পেরেছিল তার কোন যুক্তিই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অনেক পরে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে পেরেছিলাম আমাদের কুমিল্লা অপারেশনের পর পার্টির তরফ থেকে শেখ মুজিবের উপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল আমাদের বিশেষ করে আমার ঔদ্ধত্বের উপযুক্ত শিক্ষা দেবার জন্য। কিন্তু শেখ মুজিব ঐ চাপের পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলেন, “আর্মি কোন কাঁচা কাজ করে নাই। তারা আইন অনুযায়ী সবকিছু করছে, প্রত্যেককে ধরেছে হাতেনাতে প্রমাণসহ সে ক্ষেত্রে আমি কি করতে পারি?” তার ঐ কথায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ আওয়ামী নেতাদের একাংশ। আইনের মাধ্যমে যদি কোন কিছু করা না যায় তবে অন্য কোনভাবে হলেও শিক্ষা তাদের দিতেই হবে এবং সেই দায়িত্বটাই গ্রহণ করেছিলেন সেই সময়ের Top terror and most powerful leader বলে পরিচিত গাজী গোলাম মোস্তফা। তখন থেকেই নাকি সুযোগ খুঁজছিলেন তিনি জিঘাংসা মিটাতে। বিয়ে বাড়িতে বাপ্পি এবং তার ছেলেদের মাঝে যে সামান্য ঘটনা ঘটে সেটাকেই সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করে গাজী চেয়েছিল আমাকে উচিত শিক্ষা দিতে। এ বিষয়ে মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি তার বই ‘বাংলাদেশ! সামরিক শাসন এবং গণতন্ত্রের সংকট’ এ লিখেছেন, “গাজী সমর্থক লোকদের সম্ভবতঃ মেজর ডালিম ও তার স্ত্রীকে হত্যা করার পরিকল্পনা ছিল।” সংগৃহীত
Posted on: Tue, 05 Aug 2014 17:20:41 +0000

Trending Topics



Recently Viewed Topics




© 2015