এটা প্রেমই হওয়ার ছিল - TopicsExpress



          

এটা প্রেমই হওয়ার ছিল । কিন্তু অন্য কিছু হয়ে গেল । যা হবার ছিল, তা হল না । এভাবে আমরা ভারতীয়রা কথা বলি না, বললেও গান কি কবিতার পাতায় লিখি না কখনোই । সর্বগ্রাসী নৈরাশ্য এখনো কিন্তু ভারতীয় মানসের প্রেম নামের দুর্লভ পাথর বাটিটিকে (সোনার ছিল না কোনোদিনও) ভরিয়ে দিতে পারেনি । আমরা আমাদের গানে শুনেছি ----হাঁ, এহি পেয়ার হ্যায় বা পেয়ার তো হো না হি থা-র মত প্রেমের সরব অস্তিত্বে সোচ্চার বৈপ্লবিক লিরিক । কিংবা প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে, নয় তো প্রেম এসেছিল নিঃশব্দ চরণে, তাও না হলে বেশ করেছি, প্রেম করেছি, করবই তো । সবগুলো ক্ষেত্রেই প্রেম কিন্তু আপন মহিমায় ৮৬৯ বছর পর একবার করে উজ্জ্বল হওয়া নেপচুনের দ্বিতীয় স্যাটেলাইটের মত ভয়ানক উজ্জ্বল । প্রেম ব্যাপারটাকে আমরা ভারতীয়রা কগনেটিভ লজিকে বহু আগেই যুক্তিবন্দী করে রেখেছি । অন্য সব কিছুতে Rationalism নিপাত গেলেও, প্রেমের ব্যাপারে Rational না হলে আর ভারতীয় কি হলেন আপনি ? আপনার মধ্যে অমুক-অমুক সিম্পটম দেখা গিয়েছে মানেই হাফিজুল অমায়িক হেসে বলবেন : হ্যা এইবার প্রেমে পড়সে ! তাদের প্রেমের শেষ অবধি কি গতি হল না, হ্যা বা হ্যারা কোন নাওয়ে পা দিয়া শ্যাষে কোন ঘাটে পাড়ি দিল ---সে খবর কেউ রাখলেন না, হাফিজুল তো একেবারেই না । মাত্র দু-চার কথায় প্রেমের অস্তিত্ব টের পাওয়া গেলে পর, দু-চার কথার পর তা শেষও হয়ে যেতে পারে । কিন্তু গর্বিত হতে হয় এই জন্যে যে ---কোথাও একটা প্রেম হয়ে গেল । Rational মননে তার সামাজিক, ঐতিহাসিক, ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিভিন্ন ভাগ-উপবিভাগ রয়েছে । প্লেটোনিক (বাঙালির প্রিয় সবচাইতে), সেমি-প্লেটোনিক (এই ধারণাটি বাঙালির উত্তরাধুনিক উর্বর চিন্তার মাশরুম), সামাজিক (অর্থাৎ শেষে ভিলেইনের পরাজয় ও পাত্রপাত্রীর বিয়ে), অ-সামাজিক (উত্তর-ফাল্গুনী, ওগো বধূ সুন্দরী, চারুলতা, ইত্যাদি ছায়াছবি দেখে অনুপ্রাণিত), বৈধ (পাত্র ও পাত্রী উভয়েই যদি পরিচিত হন আপনার), অবৈধ (যে কোনো সম্পর্ককেই এই আওতায় এনে ফেলা সবচাইতে সহজ), পূজনীয় (বোকা মেয়েদের চোখে সলমন খান, হাবলা ছেলের জন্যে করিনা কাপুর কি পাওলি দাম, তাদের মা-মাসির জীবনে ছিল উত্তমকুমার), এর বাইরে আর যা কিছু সেগুলো আদৌ প্রেম কিনা শেষ অবধি সংশয় রয়ে গেল । হয়ত বা প্রেম হতে পারত, কিন্তু হয়ে গেল ----অন্য কিছু । কিন্তু সত্যি কি সেটা প্রেমই হত ? আচমকা এতগুলো বাজে কথার কারণ আবার সেই গল্প । নোবেলজয়ী সাহিত্যিক এলিস মানরোর প্যাশন । অনুবাদটি প্রায় শেষের মুখে । শেষ দশ বছরে এমন গল্প পড়েছি কিনা বলা শক্ত । হয়ত পড়েছি, কিন্তু খুব কমসংখ্যক গল্পই এতটা দ্বন্দ্বে ফেলেছে আমাকে । অনুবাদটি শেষ হলে পর ওয়েবে তুলে দেব, একটু পরে দেখবেন সময় করে । ইনি সেই বিরল জাতের লেখিকা যার মধ্যে একইসঙ্গে ভর করে রয়েছেন জেন অস্টেন, টমাস হার্ডি, ডিকেন্স, ফর্স্টারের মত ধ্রুপদীরা । সেইসঙ্গে রয়েছেন চেকফ আর তলস্তয়ের মত আধুনিক গদ্যের যাঁরা প্রাণপুরুষ । আবার একইসঙ্গে আধুনিক সাহিত্যের দাবিদাওয়া মেনে তাঁর সাহিত্যে এসেছে বহুস্তরীয় অতি-সুক্ষ্ম সব মেটাফোর, সেগুলোকে ভর করে বিস্তারিত চিন্তার জাল, এবং মানানসই অতি-আধুনিক এক গদ্যধারা, যা তাঁকে তাঁর আপন সময়ের সামনে অত্যন্ত স্বতন্ত্র অথচ সরল করে তুলেছে । ইনি নোবেল-প্রাইজ পাওয়ার পর, শোনা যায় যে বাঙালি তাঁকে সিম্পলটন ভেবে নিয়ে উল্লসিত হয়েছিল, অর্থাৎ এই অশীতিপর মহিলা যদি এমন গল্প লিখে নোবেল পান ----তবে আমাদের রামলাল-টামলাল, কি বাবুলাল (কার যেন পোষা কুকুরের নাম)-রা কার থেকে কম যান কিসে ? সে যান তারা যেখানে খুশি, আমার কথাটি হল ----মানরোর প্যাশন গল্পটির প্রায় শেষে, যবনিকা-পাতের খানিক আগে, পড়তে পড়তে একটি বিশেষ দৃশ্যপটে আমার কেন জানি ---পের জাস-এর গাওয়া ইট মাস্ট হ্যাভ বিন লাভ গানটাই বেজে উঠেছিল, অন্য কোনো গান নয় । ওই দৃশ্যে এসে পড়া মাত্র কানে গান বেজে উঠবে তার কোনো মানে নেই একেবারেই, পেগান বলে হয়ত এত হরেকরকম গান আমার কানে বাজে সবসময়ে । আমি দেখেশুনে একটি স্বদেশী গান খুঁজছিলাম ওই দৃশ্যটির জন্য, কিন্তু পেলাম না কিছুতেই । সত্যি বলছি, প্যাশন গল্পের সেই গ্রেস নামের মেয়েটির সঙ্গে প্রেটি উওম্যান ছবির জুলিয়া রবার্টস অভিনীত ভিভিয়ানা (নামটা ভুল হলে শুদ্ধ করে দেবেন) নামের মেয়েটির একচুলও মিল নেই । মানরোর গল্পের সঙ্গেও ওই সিনেমার কাহিনির মিল নেই এতটুকু । কিন্তু কোথাও হয়ত কিছু একটা চিন্তার সাদৃশ্য রয়ে গিয়েছে, যেটি দীর্ঘস্থায়ী, সেইসঙ্গে আবেদনের নিরিখে এরিস্ততলের নাট্যশাস্ত্রের কোনো একটি রসের জারণ ঘটায় । গল্পটি পড়ে কেউ হয়ত (খুবই কম সংখ্যক তারা যদিও) ভাববেন ----এমন হৃদয়হীন পৃথিবীর খোঁজ বুঝি বা পশ্চিমেই পাওয়া যায়, আমাদের দেশের মানুষ এরকম না । প্রেটি উওম্যান দেখে আমার এক পরিচিত বলেছিলেন: এরকমটা ওদের দেশেই হয়, আমাদের দেশে এমন কখনই হবে না । আমরা মেয়েদেরকে সম্মান দিতে জানি। তবে আমাদের দেশে কি হয় ? বাস্তব যেখানে অনেকটাই শর্তহীন (এর জন্যে সমূলে দায়ী ভারতের বাম-লিবারেল জনতা, আর হিন্দি সিনেমা), তখন উত্তর একটাই । প্রেম হয় । মেয়ে এবং পুরুষ উভয়েই সপরিবারে এবং সসম্মানে এক প্রেমোত্তর-জীবনে সশব্দে পা রেখে মোক্ষ লাভ করে থাকে । আর হাফিজুল বলতে পারেন : হে হে ! হ্যারা প্রেম করে বিয়া করসে ! কিন্তু যে প্রেমটি হওয়ার ছিল, কিন্তু হল না ----কেন হল না সেটি কি ভাবলেন কেউ ? কি আর করা যাবে, রাধা-কৃষ্ণের প্রেম পর্যন্ত সভ্যতার সরল শর্তগুলো মেনে চলতে না পেরে শেষ অবধি মুখ থুবড়ে পড়েছিল, সেখানে আমরা শর্তের প্রতি একের পর এক কাঁচকলা প্রদর্শন করে নিঃশর্ত (বাঙালি যাকে বলে ----হেভেনলি !) এক প্রেমের খোঁজে প্রাণপাত করে চলেছি । যেটি হবে এক শর্তহীন, সংজ্ঞাহীন, এবং বাস্তব পরাভূত সম্পর্ক ---অনেকটা জয়ললিতার সঙ্গে কোনো হারানো জাহাজের নাবিকের বড় ছেলের প্রেমের মত, বা মিল্লুর সঙ্গে প্রিয়াংকা চোপড়ার, বা আমাদের লেখক-কাকুর সঙ্গে সানি লেওনের (এক্ষেত্রে প্লেটনিক হওয়াটা একান্ত প্রত্যাশিত) সম্পর্কের মত । কিন্তু কখনো কখনো একটি সমাজে ব্যক্তির একান্ত ইচ্ছে-অনিচ্ছেকে মানবসভ্যতার সাধারণ কিছু শর্ত, মূল্যবোধ, সংস্কার আর বিশ্বাস শাসন করতে শুরু করে, আর মানুষটি (পুরুষ এবং নারী উভয়ই) হয়ে ওঠে তার ধারক সভ্যতার ইতিহাসেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, যে কিনা সভ্যতার সবরকম শর্ত মেনে নিতে প্রস্তুত । সভ্যতার সরল শর্তগুলো পশ্চিমের সমাজগুলোতে বড্ড প্রকট হয়ে পড়ে কখনো-সখনো । তাই হয়ত হৃদয়হীন জগত, কিংবা হৃদয়-বিদারক দৃশ্যেরও নির্মাণ হয়ে যেতে পারে যে কোনো মুহূর্তে । তবে সেটিকেই যে চূড়ান্ত বলে মেনে নিতে হবে, তেমন কোনো শর্ত কিন্তু সভ্যতার ইতিহাসে লিখে রাখা হয়নি । ক্লাস ইলেভেনে পড়তে নিউ-এম্পায়ারে প্রথম যখন প্রেটি উওম্যান দেখি, আমার মত আরও অনেক উঠতি ছোকরা তখন জুলিয়া রবার্টসের প্রেমে পড়ে গেলেও, সিনেমাটা দেখার পর মন খারাপের ভাগীদার কিন্তু পাইনি বিশেষ । পঞ্চুবাবুর সঙ্গে আলাপ ছিল না তখন, থাকলে দেখতাম ---তাঁর নির্ঘাত চোখে জল এসে গিয়েছে, চরিত্রগুলোর হাইট আর সব শেষে ছবিতে একটা ফ্লাইট তাকে ভাবিয়ে মারত । সেই একইরকমের খারাপ লাগা (মন-খারাপ নয়) বোধ হল প্যাশন গল্পটি অনুবাদ করতে করতে । একজন অসীম ক্ষমতাশালী লেখিকা কিভাবে কথার পর কথা পেড়ে, যুক্তির পর যুক্তিকে খন্ডন করে, নতুন যুক্তির জাল বিস্তার করে, সামান্য এক মানুষের কাহিনি বর্ণনা করার ছলে কত বড় কথা বলে ফেললেন । কথাটা বললেনও এমনভাবে যে, শেষ অবধি মন ছুঁয়ে যাওয়া, বা সমৃদ্ধ হওয়া কিছুই হল না । তাই হয়ত কোনো কনটেক্সট ছাড়াই রগশেট-এর গানটা আবার মনে পড়ে গেল ---- তবু এটি হৃদয়-বিদারক । বিশেষ করে শীতের দিনে । তাই স্বপ্নে ভর করে থাকি। .....এটা প্রেমই হওয়ার ছিল । শেষটায় ভালো হওয়ার ছিল । কিন্তু আমিই তাকে হারিয়েছি । ------------(পের জাস, ১৯৮৭)
Posted on: Fri, 23 Jan 2015 09:46:41 +0000

Trending Topics



Recently Viewed Topics




© 2015