কৃষণ - TopicsExpress



          

কৃষণ চন্দর -------------------------- কৃষণ চন্দরের সাথে আমার প্রথম পরিচয়, অর্থাৎ তাঁর সাহিত্যের সাথে পরিচয় ১৯৯২ সালে। তিনি উর্দু ভাষার সাহিত্যিক। উর্দু ভাষার প্রতি আমাদের অনেকেরই এলার্জি আছে, আমারও ছিল। প্রথম যখন কৃষণ চন্দরের উপন্যাস গদার পড়ি (অবশ্যই অনুবাদের সুবাদে, কারণ আমি উর্দু পড়তে পারি না) -- আমার বিশ্বাস করতেই মন চাইছিল না, এটা উর্দু ভাষায় লিখা এবং এর লেখক একজন উর্দুভাষী। তাঁর ওই উপন্যাসটির বিষয়বস্তু ছিল সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশভাগ এবং তার প্রতিক্রিয়ায় সংঘটিত দাঙ্গা। তারপর অনেক সময় পার হয়েছে, কৃষণ চন্দরের আরো অনেক লেখা পড়ারও সুযোগ ঘটেছে। আমার বলতে দ্বিধা নেই, উর্দু সাহিত্যিক মুন্সী প্রেমচান্দ, কৃষণ চন্দর প্রমুখ লেখকদের গল্পে-উপন্যাসে আমি মুগ্ধ হয়েছি। আমার আরো মনে হয়েছ তাঁদের হাত দিয়ে উর্দু ভাষায় এমন কিছু গল্প-উপন্যাস রচিত হয়েছে যা আমি বাংলা ভাষায় পাইনি। এর বাইরেও কিছু উর্দু কবিতা এবং গজল আমাকে অতুল রসের সন্ধান দিয়েছে। উর্দু সাহিত্যের প্রতি আমার অনুরাগ ক্রমাগত বেড়েছে। ২৬ নভেম্বর কৃষণ চন্দরের ৯৫তম জন্মবার্ষিকী। এ লেখাটি শুরু করেছিলাম তখনই, কিন্তু শেষ করতে বিলম্ব হয়ে গেল। তারপরও এই মহৎ সাহিত্যিকের প্রতি বিলম্বিত প্রণাম। সাহিত্যের কাছে পাঠক কি চায়? পাঠক চায় হৃদয়ের খোরক। যদিও এ মতের অনেক বিরম্নদ্ধ এবং ভিন্ন মতও আছে। শিল্পের প্রথম এবং প্রধান গুণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রাচীন সংস্কৃত পণ্ডিতরা বলেছিলেন ‘সহৃদয় হৃদয় সংবাদী’, অর্থাৎ হৃদয়ে সংবেদনশীলতা জাগানোর ক্ষমতা। সাহিত্য সম্পর্কে এ কথা আরো প্রবলভাবে প্রযোজ্য। কৃষণ চন্দরের গল্পগুলো, এ বিচারে, রসোত্তীর্ণ। তাঁর গল্প আমাদের হৃদয়ে সাড়া জাগায়, অন্তরের অন্তস্তলে নাড়া দেয়, হৃদয়ের সংবেদনশীলতা অর্থাৎ সুকুমার বৃত্তিগুলিকে জাগিয়ে তোলে। হিন্দি এবং উর্দু এ উভয় ভাষাতে সাহিত্য সাধনা করলেও কৃষণ চন্দরের প্রধান পরিচিতি উর্দু সাহিত্যিক হিসাবে। তিনি যে সময় উর্দু ভাষায় সাহিত্যচর্চা শুরম্ন করেন তখন উর্দু সাহিত্যের গদ্য শাখাটি সবে হাঁটি হাঁটি পা পা করে সাবালকত্বের দিকে যাত্রা করেছে। কৃষণ চন্দর সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে তাই উর্দু সাহিত্য সম্পর্কেও দু’একটি কথা বলতে হয়। সারাবিশ্বে উর্দু মাতৃভাষীর সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি। ইংরেজির সাথে উর্দু পাকিস্তôানের রাষ্ট্রভাষা। তাই অনেকের ধারণা উর্দু কেবল পাকিস্তানেই প্রচলিত। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, পাকিস্তানের মাত্র ১ কোটি এবং ভারতে প্রায় ৫ কোটি মানুষের মাতৃভাষা উর্দু। উর্দু ভারতেও একটি অন্যতম সরকারি ভাষা, ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, দিল্লী এবং জম্মু ও কাশ্মীরে এটি সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃত। এছাড়া আফিগানিস্তানের শহরগুলিতে ও পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলির শহর এলাকায় এ ভাষার অল্প-বিস্তর প্রচলন রয়েছে। উর্দু ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের ইন্দো-আর্য শাখার সদস্য। উর্দু ভাষার জন্ম মুঘল সম্রাটদের সৈন্যশিবিরের অভ্যন্তরে। উর্দু শব্দটি তুর্কি ‘ওর্দু’ শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ ‘শিবির’ বা ‘ক্যাম্প’। এ ভাষার জন্ম ভারতের মাটিতে হলেও উর্দু সাহিত্য ফারসি সাহিত্যের কাছে বিপুল পরিমাণে ঋণী। অন্য সকল ভাষার মতোই উন্মেষলগ্নে কাব্যচর্চার মাধ্যমেই এ ভাষা বিকশিত হয়েছে। শেখ সাদী, মওলানা রুমী, দেওয়ান হাফিজ, ওমর খৈয়াম প্রমুখ কবির সৃষ্টিতে সমৃদ্ধ ফারসি ভাষা ও কাব্যসাহিত্যের প্রভাবে উর্দু একটি শক্তিশালী কাব্যভাষা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ইতিহাসবিদেরা মনে করেন ৮ম-১০ম শতকের দিকে ভারতে মুঘল অভিযানের সময় উত্তর ভারতের জনসাধারণ খারি বোলি কথ্য ভাষায় কথা বলত। খাড়ি বোলি ছিল দিল্লী এলাকার ভাষা, এবং বহিরাগত মুঘল শাসকেরা সাধারণ জনগণের সাথে যোগাযোগের জন্য এ ভাষাই ব্যবহার করতেন। কিন্তু মুঘল রাজদরবারের ভাষা ছিল ফারসি, ধর্ম ও বিচারকাজে ব্যবহৃত আরবি ভাষারও ব্যবহার ছিল। খাড়ি বোলি ভাষার একটি শাখা ধীরে ধীরে ফারসি ও আরবি ভাষা থেকে প্রচুর শব্দ গ্রহণ করলে উর্দু নামের এক সাহিত্যিক ভাষার উদ্ভব ঘটে। সম্রাট শাহজাহান প্রথম এ ভাষার নাম হিসাবে উর্দু শব্দটি ব্যবহার করেন বলে জানা যায়। অন্যদিকে সাধারণ জনগণের মুখের ভাষায় আরবি-ফারসির তেমন প্রভাব পড়েনি, বরং তারা সংস্কৃত ভাষা থেকে শব্দ ও সাহিত্যিক রীতি ধার করতে শুরম্ন করে এবং এভাবে হিন্দি ভাষার জন্ম হয়। এই দ্বিবিধ প্রভাবের কারণে হিন্দি ভাষা দেবনাগরী লিপিতে লেখা হয় এবং এর শব্দভাণ্ডারের বেশির ভাগই সংস্কৃত থেকে আগত। অন্যদিকে উর্দু ভাষা ফারসি লিপিতে লেখা হয় এবং এর শব্দভাণ্ডার ফারসি ও আরবি থেকে উদারহস্তে গ্রহণ করেছে। এছাড়া ভাষা দুটির ধ্বনি ব্যবস্থা ও ব্যাকরণেও সামান্য পার্থক্য আছে। ১২শ’ শতক থেকে উর্দু ও হিন্দি উভয় ভাষাই সাহিত্যের ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ১৮শ’ শতকে ইংরেজির প্রভাবে উর্দু ও হিন্দি সাহিত্যের বিকাশ ঘটে। গালিব, ইকবাল প্রভৃতি কবির রচনার বদৌলতে ১৮শ’ শতকের আগেই উর্দু কাব্যসাহিত্য যথেষ্ট উৎকর্ষ লাভ করে। কিন্তু উর্দুর গদ্যসাহিত্যের ধারাটি তখনও অত্যন্ত দুর্বল। উপন্যাস বা গল্প রচিত হলেও সেগুলি নিতান্তই অপরিণত রচনা। উর্দু সাহিত্যে প্রথম সার্থক ছোটগল্পের জন্ম দিলেন মুন্সি প্রেমচন্দ, ১৯০৮ সালে। ১৯০৮ সাল থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান - এ সময়সীমার মধ্যে উর্দু সাহিত্যে বেশ কয়েকজন শক্তিশালী কথাশিল্পীর আবির্ভাব ঘটে। উর্দু সাহিত্যের ইতিহাসে এঁরা ‘রূমানবী’ গল্পকার নামে পরিচিত। প্রেমচন্দ, এস আসলাম, পণ্ডিত সুদর্শন, সাজ্জাদ হায়দর এলমদর, মজনুঁ গোরাখপুরী, এল আহমদ, হজাব ইসমাইল প্রমুখ এ গোষ্ঠীর উলেস্নখযোগ্য লেখক। ‘রূমানবী’ গোষ্ঠীর লেখকদের রচনাশৈলী ও ভাষা অত্যন্ত চমৎকার, কিন্তু তাঁদের গল্পগুলি ভাবাবেগে ভারাক্রান্ত, বাস্তবতাবর্জিত। প্রেমচন্দ ‘রূমানবী’ গোষ্ঠীর লেখক হিসেবে সাহিত্য-সাধনা শুরু করলেও ‘রূমানবী’-সাহিত্যধারার পরিবর্তন তাঁর হাতেই ঘটেছে। সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবনের নানা সমস্যাকে বিষয়বস্তু করে তিনি অসংখ্য ছোটগল্প ও বেশ কয়েকটি উপন্যাস রচনা করেন। তাঁর একটি গল্পগ্রন্থ ‘জন্মভূমির জ্বালা’ (সোজে ওত্.ন) ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনসাধারণকে উত্তেজিত করার অভিযোগে নিষিদ্ধ হয়। মুন্সি প্রেমচন্দের হাত দিয়েই উর্দু ছোটগল্প বিশ্বসাহিত্যে আপন আসন করে নিতে সক্ষম হয়। কৃষণ চন্দরের আবির্ভাব এর পরের ঘটনা। কৃষণ চন্দর জন্মেছিলেন ১৯১৪ সালের ২৬ নভেম্বর তৎকালীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের পশ্চিম পাঞ্জাবের গুজরানওয়ালা জেলার ওয়াজিরাবাদ নামক এক ছোট শহরে। যদিও তিনি এক চিঠিতে তাঁর জন্মস্থান লাহোর বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর পুরো নাম কৃষণ চন্দর শর্মা। জন্মসূত্রে তিনি কাশ্মীরী ব্রাহ্মণ। তাঁর পিতা ছিলেন কাশ্মীরের ভরতপুর নামক এক ছোট রাজ্যের স্বনামধন্য চিকিৎসক। কৃষণ চন্দরের শৈশবেই তিনি ভরতপুর ছেড়ে পুঞ্ছ রাজার অধীনে ডাক্তার হিসাবে নিযুক্ত হন। তখনকার দিনে সাধারণত মেয়েরা হিন্দী ভাষার চর্চা করত, কিন্তু পুরুষেরা শিক্ষা গ্রহণ করত উর্দু ভাষাতে। তাই কৃষণ চন্দরকেও উর্দু ভাষার মাধ্যমেই শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। তিনি পড়াশোনা করেন পুঞ্ছ হাইস্কুলে। শৈশব থেকেই নাটক ও যাত্রাপালার প্রতি তাঁর প্রবল অনুরাগ ছিল। কিছুদিন তিনি চিত্রাঙ্কনের চর্চাও করেছেন। সাহিত্যের প্রতি তাঁর আকর্ষণ গড়ে ওঠে শৈশবেই। কিন্তু সাহিত্য-সাধনার পথে বাধা ছিল মায়ের চোখরাঙানি আর বাবার কঠোর নির্দেশ। এসব অমান্য করেই স্কুল-জীবন থেকে অতি গোপনে তাঁর সাহিত্যচর্চা শুরু। শৈশবে কৃষণ কিছুদিন কাশ্মীরে ছিলেন। কাশ্মীরের নৈসর্গিক প্রাকৃতিক শোভা নিশ্চিতভাবেই তাঁর মনে কাব্যিক অনুভূতির জন্ম দিয়েছিল। শৈশবে তিনি দীর্ঘদিন অসুস্থ হয়ে গৃহবন্দি জীবন কাটিয়েছেন। না স্কুলে যেতে পারতেন, না পারতেন বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে। দিনের পর দিন চলে গেছে ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে, এমনকি বই-পুস্তকের সঙ্গেও তাঁর দেখা-সাক্ষাৎ হত না। এ সময় তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা চোখ বুজে নিজের সম্পর্কে, মা-বাবার সম্পর্কে, জীবন এবং মৃত্যু সম্পর্কে, জানালার বাইরের কাশ্মীরের উদার প্রান্তর আর শ্যামল উপত্যকা সম্পর্কে, পাহাড়ের চড়াই-উৎরাইতে ভারী বোঝা মাথায় নিয়ে যে সব নিম্নবিত্ত দরিদ্র কাশ্মীরীদের তিনি যেতে দেখতেন - তাদের সম্পর্কে এবং নিজের তিক্ত-অসুস্থতা সম্পর্কে ভাবতেন। সম্ভবত এভাবেই নিজের বেদনা আর অপ্রাপ্তির সঙ্গে ভারতের আর সারাবিশ্বের মানুষের বঞ্চনা-বেদনা, আশা-নিরাশার সঙ্গে তিনি একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন আর্য-সমাজী আর মা ছিলেন নিষ্ঠাবান হিন্দু। তাঁর ডাক্তার পিতা ধর্মীয় গোঁড়ামী থেকে ছিলেন সম্পূর্ণ মুক্ত। ধর্ম সম্পর্কে উদার মনোভাব গড়ে ওঠার পেছনে তাঁর পিতার একটা বড় ভূমিকা ছিল। পুঞ্ছ হাইস্কুলের পাঠ শেষে করে তিনি লাহোরের ফার্মন খ্রিষ্টান (এফ সি) কলেজে ভর্তি হন। এ সময় তিনি শহীদ-ই-আজম ভগৎ সিং-এর গদর পার্টিতে যোগ দেন এবং এর ফলে একবার তাঁকে দু’মাসের জন্য কারাবাসও করতে হয়েছিল। কিন্তু সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে পুলিশ তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। কলেজ জীবনেই তাঁর প্রথম গল্প ‘য়র্কান’ (কামলা) ‘রিয়াসত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। লাহোরের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এমএ এবং এলএলবি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৩৬ সালে তাঁর রম্যরচনা ‘হাওয়াই কিলা’ তৎকালীন প্রগতিশীল পত্রিকা ‘হুমায়ূঁ’-তে প্রকাশিত হলে রচনাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রশংসিত হয়। কিছুদিন পর ওই পত্রিকাতেই তাঁর গল্প ‘ঝিলম মে নাও পর’ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি লেখক হিসাবে পরিচিতি পেয়ে যান। ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘প্রগতি লেখক সংঘ’। এ বছরই লেখক হিসাবে কৃষণ চন্দরের আবির্ভাব। লখনৌয়ে অনুষ্ঠিত প্রগতি লেখক সংঘের প্রথম সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন মুন্সী প্রেমচন্দ, সাজ্জাদ জহির ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আল্লামা ইকবাল ও কাজী নজরুলের আশীর্বাদে ধন্য হয়েছিল এ সম্মেলন। এ সংঘের পতাকাতলে উর্দু ও হিন্দি যে সাহিত্যিকরা সমবেত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে কৃষণ চন্দর, রাজেন্দ্র সিং বেদী, আসমত চুঘতাই, আহম্মদ আলী, আলী আব্বাস হুসায়নী, মুলুকরাজ আনন্দ, সাদাত হোসেন মান্টো, খাজা আহমদ আব্বাস, শওকত সিদ্দিকী, গোলাম আব্বাস, আহমদ নদিম কাসমী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কৃষণ চন্দরের প্রথম প্রকাশিত গল্প-সংকলন ‘তিলিসম্-এ-খেয়াল’। প্রথম উপন্যাস ‘শিকস্ত’, এটি রচনা শুরু হয় ১৯৪০ সালে। বস্তুত, প্রথম গল্প থেকেই কৃষণ চন্দরের মানবতাবাদী সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হয়েছে। এরপর তিনি একে একে অজস্র গল্প ও উপন্যাস লিখে উর্দু এবং হিন্দি সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে তোলেন। সারা ভারতেই তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। বাংলা ও ভারতীয় বিভিন্ন ভাষা ছাড়াও রুশ, জার্মান, ইংরেজি, চেক, হাঙ্গেরি, পোলিশ, চীন ও জাপানি ভাষায় তাঁর সাহিত্য অনূদিত হয়েছে। উর্দু ও হিন্দি ভাষায় তাঁর ৩০টি ছোটগল্প সংকলন এবং ২০টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। কৃষণ চন্দরের গল্পগ্রন্থগুলির মধ্যে ‘তিলিসম্-এ-খেয়াল’, ‘টুটে তারে’, ‘পুরানে খুদা’, ‘অন্নদাতা’, ‘তিন গুন্ডে’, ‘অজন্তা সে আগে’, ‘নয়ে আফসানে’, ‘মজাহিয়া আফসানে’, ‘মিস নৈনিতাল’, ‘কাশ্মীর কি কহানী’, ‘নয়ে গুলাম’, ‘কিতাব কা কফন’, ‘কালা সুরাজ’, ‘হম্ বহশী হ্যাঁয়’ ইত্যাদি উলেস্নখযোগ্য। তাঁর উপন্যাসগুলোর মধ্যে ‘শিকাস্ত’, ‘যব খেত জাগে’, ‘গদ্দার’, ‘কাগজ কি নাও’, ‘কাগজ কি নাও’, ‘কার্নিওয়ালা’, ‘বাওন পাত্তে’, ‘আয়নে একেলে হ্যাঁয়’, ‘আধা রাস্তা’, ‘তুফান কি কালিয়াঁ’ প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শিশুদের জন্য রচিত ‘দাদর পুলকে বাচ্চে’, ‘লাল তাজ’, ‘উল্টা দরখ্ৎ’, ‘চিড়িয়া কি আলিফ লায়লা’ শিশু-সাহিত্যের সীমানা ছাড়িয়ে মহৎ সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করেছে। এছাড়া রয়েছে তাঁর শৈশব স্মৃতিচারণমূলক রচনা ‘ইয়াদোঁ কি চিনার’। ‘দরওয়াজা’ তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটিকা সংকলন। তাঁর রম্যরচনা সংকলনগুলির মধ্যে ‘দেওতা আওর কিষাণ’, ‘নজারে’, ‘এক গাদ্ধে কি সর্গুজাশ্ৎ’ বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। তাঁর রম্যরচনাগুলি একাধারে হাস্য-কৌতুক ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে সমুজ্জ্বল। তীক্ষ্ণ ছুরির ফলার মতো সেগুলি পাঠকের চোখের সামনে ঝলসিয়ে ওঠে। কর্মসূত্রে প্রথম জীবনে তিনি লাহোর বেতার কেন্দ্রে এবং পরে দিল্লী বেতার কেন্দ্রে কর্মরত ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কাশ্মীরী বাজারের একটি ছোট বাংলো হতে দিল্লী রেডিওর অনুষ্ঠান সম্প্রচার হত। কৃষণ চন্দর, সাদত হাসান মান্টো, উপেন্দ্রনাথ আশক্ - এঁরা তিনজন সেখানে কাজ করতেন। আর এঁদেরকে ঘিরেই দিল্লী রেডিও স্টেশন হয়ে উঠেছিল এক সাহিত্য-মজলিশ। আশরার উল হক মজাজ ছিলেন রেডিওর উর্দু ম্যাগাজিন ‘আওয়াজ’এর সম্পাদক। তাদের সাথে যোগ দিতেন ফয়েজ আহমদ ফয়েজ ও চিরাগ হাসান হাসরত। এ মজলিশের মধ্যমণি ছিলেন কৃষণ। এরপর সরকারি চাকুরি ছেড়ে তিনি পুরোপুরি সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৪৩ সালের বাংলার ভয়াবহ মন্বন্তর নিয়ে রচিত কৃষণ চন্দরের গল্প ‘অন্নদাতা’ অবলম্বনে বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা খাজা আহমদ আব্বাস ১৯৪৬ সালে নির্মাণ করেন ‘ধরতি কে লাল’। কৃষণ চন্দরের গল্পকে অবলম্বন করে কাহিনী (স্ক্রিপ্ট) রচনা করেন যৌথভাবে খাজা আব্বাস এবং বিখ্যাত নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য। এ চলচ্চিত্রে সুরারোপ করেছিলেন রবি শঙ্কর। অভিনয় করেছিলেন বলরাজ সাহানী, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি ভাদুরির মতো নামকরা সব অভিনেতা। এরপর থেকে বোম্বাইয়ের চলচ্চিত্র জগতেও (এখনকার বলিউড) তিনি সম্পৃক্ত হন, সিনেমার কাহিনী লেখক হিসাবে। যদিও এ কাজে তিনি ততটা সাফল্য পান নি। তাঁর গল্প অবলম্বনে ‘মা ভূমি’ (গৌতম ঘোষ, তেলেগু), ‘মা ভূমি’ (হিন্দি), ‘রাম ভরস’ (হিন্দি), ‘মনচালি’ (হিন্দি), দো ফুল (হিন্দি), ‘আন্দোলন’ (হিন্দি) এবং ‘শরাফত’ (হিন্দি, এ ছবিটি যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করে) ইত্যাদি ছবি নির্মিত হয়। মানবতাবাদ ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের জন্য ১৯৬৬ সালে সোভিয়েত ল্যান্ড নেহেরু কমিটি কৃষণ চন্দরকে তাদের প্রথম সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত করে। এরপর ১৯৬৯ সালে তিনি ভারত সরকারের ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি লাভ করেন। এই মহান সাহিত্যক মৃত্যুবরণ করেন ১৯৭৭ সালের ৮ মার্চ, মুম্বাইতে নিজের ঘরের লেখার টেবিলে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও তিনি লিখছিলেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয় তাঁর শেষ উপন্যাস ‘ফুটপাত কে ফারিশতে’ (ফুটপাতের দেবদূতেরা) ‘বিসুইঁ সাদী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। খাজা আহমদ আব্বাস কৃষণ চন্দর সম্পর্কে লিখেছেন, “মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে এশীয় ভাষাসমূহের এক কলেজে আমাদের আমন্ত্রণ জানানো হল। উর্দু সাহিত্যের ব্যাপারে আমরা কিছু আলোকপাত করব, এই উদ্দেশ্যে। ... বক্তৃতা শেষ হতেই আমার প্রতি প্রশ্নের বারিবর্ষণ চলল। ... এদের বেশীরভাগ প্রশ্নই ছিল কৃষণ চন্দর সম্পর্কে। এরা নাকি কৃষণ চন্দরের বই পড়েছে। ... এরপর এক পাঠাগার পরিদর্শন করতে গিয়ে জানলাম, যে ক’জন ভারতীয় লেখক রুশ ভাষায় তরজমা হয়েছে, তন্মধ্যে কৃষণ চন্দরের লেখাই বেশী আলোড়ন সৃষ্টিকারী। ... সর্দার জাফরী এদেরকে (কৃষণ চন্দর ভক্তদেরকে) উত্তেজিত করার জন্য বলল, কিন্তু আমরা তো কৃষণ চন্দরকে তেমন পছন্দ করি না। তার লেখায় তেমন কোনো উচ্চাঙ্গের ছাপ নেই। তার সব লেখাই রোমান্টিক ধরনের।’ মেয়েরা সমস্বরে বলল, ‘এই জন্যই তো আমরা তাঁকে পছন্দ করি। তাঁর রোমান্টিক লেখায় সমাজের সত্যিকার চিত্র পাওয়া যায়।’ জাফরী আলোচনা বিলম্বিত করার জন্যে বলল, ‘ফুল সুরখ হ্যায়’ উপন্যাসে (এক অন্ধ ফুল বিক্রেতাকে কেন্দ্র করে রচিত) আমি তো মনে করি ভারতীয় মজুরদের সত্যিকার চিত্র ফুটে ওঠে নি।’ এ কথা বলতেই একজন মজুর শ্রেণীর লোক প্রতিবাদ করে বলল, ‘কে বলে এতে মজুরদের চিত্র প্রস্ফুটিত হয় নি? মজুরদের বাহ্যিক চিত্র এতে না ফুটে থাকলেও তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং অন্তর্জগতের সম্পূর্ণ আবেদন এতে ফুটে উঠেছে।’” সবশেষে খাজা বলছেন, “কৃষণ চন্দর জীবনকে ভালবাসেন বলে এমন কাহিনী লিখতে পেরেছেন। সৌন্দর্য এবং প্রাকৃতিক দৃশ্যের এমন কাব্যময় প্রকাশ সচরাচর কোনো গদ্য-লিখিয়ের দ্বারা সম্ভব হয় না। - কৃষণ চন্দরের লেখা পড়ে মনে হয় তিনি একজন কবি। কিন্তু তাঁকে কেউ কবি বলে না।” কৃষণ চন্দরের সাহিত্য-কীর্তি মূল্যায়ণ করতে গিয়ে মহেন্দর নাথ লিখেছেন, “কৃষণ চন্দরের রচনাশৈলী এমন স্বচ্ছন্দ, স্বতঃস্ফূর্ত ও সুন্দর যে সেটা যে-কোনো ভাষাবিদের কাছেও ঈর্ষার বস্তু। শব্দের দোলাচাল, শব্দের গাঁথনির কমনীয় সৌন্দর্য, বক্তব্যের গভীরতা, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও লঘু কৌতুকের হাস্যচ্ছটার ভেতর দিয়ে রচনা ধীরে ধীরে যেভাবে প্রকৃতির বৈচিত্র্য, মানুষের মনুষ্যত্ব ও মহত্বের সৌন্দর্য এবং একই সঙ্গে পাশবিকতার এক পূর্ণাঙ্গ আখ্যায়িকায় পরিণত হয়, সেটা শুধু কৃষণ চন্দরের কাহিনীর মধ্যেই পাওয়া যায়, অন্য কোথাও নয়।” বস্তুত সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃষণ চন্দর যে চমকপ্রদ প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন সেটা যে-কোনো দেশের যে-কোনো ভাষার সাহিত্যের জন্য আত্মশ্লাঘার বস্তু। লেখক হিসাবে প্রতিষ্ঠা থেকে নিজের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি প্রগতি লেখক সংঘের সদস্য ছিলেন। যুক্ত ছিলেন বামপন্থি আন্দোলনের সঙ্গে। শোষিত-নিপীড়িত মানুষের পক্ষে, সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠণবৃত্তির বিরুদ্ধে আজীবন এক অক্লান্ত সৈনিকের মতো নিজের লেখনীকে ব্যবহার করেছেন। এ কথা নিদ্বির্ধায় বলা যায়, নির্যাতিত মানুষের সরব কণ্ঠস্বরের অপর নাম কৃষণ চন্দর। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক বিভেদ-বিদ্বেষ ও দাঙ্গার ভয়বহতা, বাংলার ৪৩-এর মন্বন্তরের ভয়াবহতা, কৃষক জীবনের দুর্দশা, শ্রমিকের অসহায়ত্ব ও সংগ্রাম, নর-নারীর প্রেম, কামনা-বাসনা - সবই ফুটে উঠেছে তাঁর গল্পে। তাঁর শৈশব স্মৃতিচারণ ‘ইয়াঁদো কি চিনার’-এ আমরা দেখছি তাঁর পিতা বলছেন, “চাষীদের ঘর - কী আছে তা দিয়ে চেনা যায় না, কি নেই তাই দিয়ে চেনা যায়।” কেমন সেই চাষীদের ঘর? “চারটি খালি দেয়াল, খালি মেঝে, পাথরের একটি তাওয়া - কোথাও তুমি এমনটা দেখেছ খোকা? একটা ট্রাউট মাছ যে সুবিধা পায়, একটি কিষাণও তাই পেয়ে থাকে।” কিশোর কৃষণ চন্দর বলছে, “কিন্তু ডোলা তো মাছ নয় বাবা।” তাঁর পিতার জবাব - “তা ঠিক। কিন্তু মাঝে মাঝে আমি ভাবি - মাছ থেকে মানুষ হবার জন্য কত শত বছর ধরে এত চেষ্টা চরিত্র আমাদের - তা কিসের জন্য?” দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে রচিত গল্পগুলোতে তিনি মর্মস্পর্শীভাবে তুলে ধরেছেন হাজার লক্ষ মানুষের উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়ার দুর্দশা ও দুর্ভোগ, সম্ভ্রম হারানো নারীর চোখের জল, সন্তান হারানো মায়ের আর্তনাদ, স্বজন হারানোর হাহাকার, আপন ভিটে-মাটি হারিয়ে উন্মূল হওয়ার বেদনা। দেখিয়েছেন কি করে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে আচ্ছন্ন প্রতিবেশী - একদিন যারা গলাগলি করে একাকার হয়ে ছিল, এক সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জীবনের সকল সুখ-দুঃখ ভাগ-বাঁটোয়ারা করত - তারা একে অপরের হন্তারক হয়ে দাঁড়াল, একে অপরের রক্তে মাটি কলুষিত করল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার গল্পগুলোতে বীভৎসতা নৃশংসতা আর পাশবিকতার অভিযোগ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলছেন, “আমার চোখের জল এখনো শুকিয়ে যায় নি। যদিও আমি জানি, অনেকের অশ্রু শুকিয়ে গেছে, অনেকের চোখে অশ্রু আসবার কোনো কারণই ঘটেনি। কিন্তু আমার কান্নার শেষ যে এখনও হয় নি - তাতে আমার কী করার আছে? আমি হৃদয়মন থেকে সবকিছু মুছে ফেলার চেষ্টা করেছি, নিজের অন্তর থেকে মানবিক সব অনুভূতি উপড়ে, ছুঁড়ে ফেলে দিতে চেয়েছি। লোকে যেমন করে পোড়া আলু চিবিয়ে খেয়ে ফেলে, তেমন করে আমি সব কিছুকে এবং ওইসব পাশবিক বীভৎস ঘটনাকে চিবিয়ে গিলে ফেলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারি নি। না, কোনো ভাবেই, চেষ্টা করেও পারি নি। হ্যাঁ, নিজের এই অক্ষমতা আমি স্বীকার করছি।” পৃথিবীর প্রতিটি হৃদয়বান ব্যথিত মানুষের হয়েই যেন তিনি বলছেন - “আমাদের চোখে অনেক জল। অতি সহজে, কারণে অকারণে, যখন তখন কান্না চলে আসে। অনেকে আমাদের চোখের জলকে দুর্বলতা মনে করে, উপহাস করে। কিন্তু কি করব আমরা? এখনো আমাদের অন্তর-জ্বালা, হৃদয়ের কোমলতা আর চোখের জল ফুরিয়ে যায় নি, শেষ হয়ে যায় নি। আমরা যখন আরো বেশী সভ্য হব, তখন হয়ত অশ্রুকে জীবন থেকে বিদায় দিতে পারব।” শুধু বিষয়বস্তুর অভিনবত্বে নয়, ছোটগল্পের আঙ্গিক নিয়েও কৃষণ সারা জীবন নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। এ সম্পর্কে তিনি বলছেন, “পুরনো আঙ্গিকে নতুন সমাজের বিষয়বস্তু তুলে ধরা আমাদের প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এখন গল্পের আঙ্গিকের রূপান্তর ঘটানোও প্রয়োজন। ... আঙ্গিকের নানা বৈচিত্র্যের ওপরই এর বিস্তৃতি ও ক্ষমতা নির্ভর করে। উপন্যাস, নাটক, রম্যরচনা, কবিতা - নিজের সীমাবদ্ধতা দিয়েই ছোটগল্প সাহিত্যের সমস্ত দিগন্তকে স্পর্শ করে। আমি এর পরিধি ও ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রতিদিনই কিছু না কিছু বলেছে এবং তাকে উন্নত থেকে উন্নততর সৌন্দর্য ও তাৎপর্যমণ্ডিত করার জন্য আঙ্গিকের নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চালিয়েছে।” আসলে গল্প-উপন্যাসের আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর এত বৈচিত্র্য খুব কম লেখকের রচনাতেই পাওয়া যায়। গণমুখী সাহিত্যের বিষয়বস্তু ও গণজীবনের সাহিত্য-স্রষ্টার দৃষ্টিভঙ্গি কি রকম হওয়া উচিত, সে সম্বন্ধে তাঁর বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট - “যদিও জীবনের নাটকীয়তা ও দ্রম্নত পরিবর্তনশীলতার ওপর লেখা খুব দরকার, কিন্তু আমার ধারণা, জীবনে পরিবর্তন ও বিকাশ, যাকে আমরা বিপস্নব বলে থাকি, সেই পরিবর্তন ও বিকাশের এক মহান রূপ আছে। এই পরিবর্তন, এই বিপ্লব প্রাত্যহিক জীবনে খুব ধীরে ধীরে মৃদুভাবে এগোতে থাকে। যে জন্য যদি মানুষের জীবনের সাদা-সিধে ছবিও আঁকি, সেটা জলরঙেই হোক কিংবা তেলরঙেই হোক, তাতে পরিবর্তন ও বিকাশের দিকটাই চোখে পড়বে। তাতে দারুণ তত্ত্বকথার সৃষ্টি না হোক, যা বুর্জোয়া সাহিত্য দীর্ঘকাল ধরে আমাদের শুনিয়ে আসছে, গল্পের আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর পরির্বতন অবশ্যই ঘটবে, এবং তা অবশ্য করণীয়। উদাহরণ হিসাবে ও. হেনরী এবং মোপাসাঁ যেখানে পৌঁছেছিলেন, গল্প এখন সেখানেই থেমে থাকতে পারে না। ওঁরা এখন আর গন্তব্যস্থল হয়ে নেই, পথের চিহ্ন হয়ে গেছেন। আমরাও একদিন এমনি পথের চিহ্ন হয়ে দাঁড়াব, একেই অগ্রগতি বলে, আর সেটাই হল মানুষের শ্রেষ্ঠ প্রাণবন্ত গল্প। কেন না, কখনও তা একটি গন্তব্যস্থলে পৌঁছেই থেমে যায় না, ক্রমশ এগোতেই থাকে, এগোতেই থাকে ...।” মানুষ এগোবে, মানুষ এগোতেই থাকবে - এ আশাবাদ, কৃষণ চন্দরের মতো আমাদেরও আছে। মানুষ অনেক এগিয়েছে - মাছ থেকে মানুষ - যেমনটি কৃষণ চন্দরের পিতার কথায় আমরা পাই। কিন্তু সেই সঙ্গে তাঁর ছুঁড়ে দেওয়া এ প্রশ্নটিও আমাদের বুকে এসে আঘাত করে - এ অগ্রগতি কিসের জন্য? আসলে কতদূর এগিয়েছে মানুষ? প্রবল আশাবাদ সত্ত্বেও বিভিন্ন গল্পে কৃষণ চন্দরকে আমরা সখেদে উচ্চারণ করতে দেখি - “মানুষের মানুষ হতে এখনো অনেক বাকি।” কৃষণ চন্দরের লেখা পড়তে পড়তে আমরা যখন চারপাশে তাকাই, - সেই অভাব আর বঞ্চনা, সেই নিপীড়ন আর বর্ববরতা আর পাশবিকতা, সেই স্বার্থপরতা আর হৃদয়হীনতাই দেখতে পাই সর্বত্র - তখন কি আমাদেরও মনে হয় না, মানুষের মানুষ হতে এখনো অনেক বাকি? -- লেখাটি আবু নাঈম -এর somewhereinblog.net/blog/Nayeem76/29054804
Posted on: Tue, 26 Aug 2014 09:56:02 +0000

Trending Topics



ss="stbody" style="min-height:30px;">
German Chancellor Angela Merkel in an address to their Parliament

Recently Viewed Topics




© 2015