পদ্মা সেতু - TopicsExpress



          

পদ্মা সেতু উপাখ্যান ******************* পদ্মা সেতু স্ক্যাম, পদ্মা সেতু স্ক্যান্ডাল কিংবা পদ্মা সেতু দুর্নীতি প্রভৃতি বহুল প্রচলিত ও মুখরোচক শব্দ ব্যবহার করতে না পারায় শুরুতেই পাঠকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। পদ্মা সেতু প্রকল্প ঘিরে এ পর্যন্ত যে উচ্চমার্গের নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে তাতে ‘পদ্মা সেতু উপাখ্যান’ বলাটাই অধিকতর যুৎসই মনে করি।পদ্মা সেতু নির্মাণ কেবলই সরকারের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার নয়; গুরুত্বপূর্ণ এ সেতুটি নির্মিত হলে দেশের এক বিরাট অংশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পাশাপাশি গোটা দেশ ও জাতির আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে তা প্রভূত ভূমিকা রাখবে। এক হিসাবে দেখা গেছে, পদ্মা সেতু নির্মিত হলে দেশের জিডিপি প্রায় দুই শতাংশ বেড়ে যাবে। তাই এ কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে, পদ্মা সেতু দেশের একক বৃহত্তম অবকাঠামো উন্নয়ন বিষয়ক প্রকল্প। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠিত হওয়ার পর পরই এ অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। সর্বমোট ২.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ২.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ সুবিধার প্রতিশ্র“তি পাওয়া গিয়েছিল। বাকি অংশের প্রতিশ্র“তি আসে এডিবি, জাইকা ও আইডিবি থেকে।পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ যখন শুরু হয়, তখন বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর ছিলেন এলেন গোল্ডস্টেইন। তার কল্যাণে প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুতেই দেখা দেয় হরিষেবিষাদ। প্রকল্পটির পরামর্শক সংস্থা নির্বাচন নিয়ে কথা তোলে বিশ্বব্যাংক। মন্ত্রী-উপদেষ্টা-সচিবসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়, তারা পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে এসএনসি লাভালিন নামক একটি প্রতিষ্ঠান থেকে আর্থিক সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাছাড়া এমন একটি কথাও চাউর হয়, কয়েকজন ব্যক্তি লাভালিন থেকে ঘুষ গ্রহণ করতে চেয়েছেন; কিংবা উল্লিখিত কোম্পানি কাজটি বাগিয়ে নেয়ার জন্য বাংলাদেশের কয়েকজন সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তিকে উৎকোচ দিতে চেয়েছে। এক্ষেত্রে অকাট্য প্রমাণ হিসেবে দাঁড় করানো হয় উল্লিখিত কোম্পানির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ব্যক্তিগত ডায়েরি। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে ক্রিমিনাল কন্সপিরেসি আখ্যা দিয়ে বলা হয়, তারা লাভালিন কোম্পানির কর্মকর্তা রমেশ সাহার ডায়েরি থেকে জানতে পেরেছেন পরামর্শক নিয়োগের বিনিময়ে কাকে কী পরিমাণ হারে অর্থ দেয়ার কথা ছিল। ওই ডায়েরির এক স্থানে নাকি লেখা রয়েছে : সৈয়দ আবুল হোসেন (যোগাযোগমন্ত্রী) ৪ শতাংশ, আবুল হাসান চৌধুরী (সাবেক প্রতিমন্ত্রী) ২ শতাংশ, মসিউর রহমান (প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা) ১ শতাংশ, মোশারফ হোসেন ভূঁইয়া (সচিব সেতু বিভাগ) ১ শতাংশ ইত্যাদি। উল্লেখ্য, ডায়েরিতে পরিষ্কার করে বলা হয়নি এ হিসাবটি কিসের। এ পরিমাণ অর্থ কি কোম্পানি দিতে চেয়েছিল, নাকি একেবারেই দিয়ে ফেলেছে। প্রমাণ দূরে থাক, কোনো ধরনের উল্লেখও নেই ওই ডায়েরিতে।যা হোক, বিষয়টি নিয়ে শোরগোল শুরু হওয়ার একপর্যায়ে বিশ্বব্যাংক মহাদুর্নীতির অভিযোগ এনে এ প্রকল্পে তাদের দেয়া আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্র“তি স্থগিত ঘোষণা করে। পরে বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে অনেক যোগাযোগ ও আলোচনার পর বিশ্বব্যাংকের সুর নরম হয় এবং একপর্যায়ে তারা আবার পদ্মা সেতুতে আর্থিক সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্র“তি পুনর্ব্যক্ত করে। এ সময় বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ের কিছু কথাবার্তায় বিশ্বব্যাংক আবার গোস্ব^া হয় এবং ঋণ সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে কঠিন শর্ত আরোপ করে। এর মধ্যে একটি শর্ত হল বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত দল ঢাকায় আসবে এবং দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সবার সঙ্গে কথাবার্তা বলে তারা কেবল সন্তুষ্টি লাভ করলেই ঋণ প্রদানের বিষয়টি পুনর্বিবেচনায় আসবে।এ সিদ্ধান্তের আলোকে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রসিকিউটর লুইস মরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। তদন্ত টিম যথারীতি ঢাকায় আসে, তদন্ত সম্পন্ন করে প্রাথমিকভাবে সন্তোষ প্রকাশ করে এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে সহযোগিতা প্রদানের জন্য ধন্যবাদও জানিয়ে যায়।পদ্মা সেতু প্রকল্পের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের বাঁচা-মরার প্রশ্ন জড়িত। এর সঙ্গে জড়িত একটি সরকার এবং দেশ ও জাতির সম্মান ও ভাবমূর্তি। সঙ্গত কারণে বিষয়টির ওপর বিশ্বব্যাংকের ত্বরিত সিদ্ধান্ত আশা করা হয়েছিল। কিন্তু এ তদন্ত কমিটি তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ তথা দুর্নীতি দমন কমিশনকে পত্র পাঠাতে সময় নেয় ছয় মাসেরও বেশি। একটি তদন্ত রিপোর্ট দিতে এত বিলম্ব হলে নানা ধরনের প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক।আমার ধারণা, পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতি বা অন্যকিছুর তুলনায় রাজনীতি অনেক বেশি ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে শুরু থেকেই বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন কান্ট্রি ডিরেক্টর এলেন গোল্ডস্টেইন যে ভাবসাব দেখিয়েছেন এবং বৈপ্লবিক বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন, তাতে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যখন দ্বিতীয় পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্প সহায়তার ঘোষণা দেয়, তখন এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি এও বলেন, শুধু পদ্মা সেতু প্রকল্পের স্বচ্ছতাই যথেষ্ট নয়, বিশ্বব্যাংকের সহায়তা পেতে বাংলাদেশ সরকারকে আরও অনেক প্রতিশ্র“তি দিতে হবে। বিষয়টি পরিষ্কার করতে গিয়ে তিনি প্রচ্ছন্নভাবে একথাও বলতে চেয়েছেন, আগামী নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হবে কিনা সে বিষয়েও সরকারকে প্রতিশ্র“তি দিতে হবে। এখানেই শেষ নয়, অতি উৎসাহের সঙ্গে তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর ব্যাপারে তার (বিশ্বব্যাংকের) দৃঢ় পদক্ষেপের পেছনে বাংলাদেশের মানুষের ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। তার এ ধরনের বক্তব্য এতই খোলামেলাভাবে উপস্থাপন করা হয় যে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী স্বভাবসুলভ কৌতুক করে বলেছিলেন, তিনি (গোল্ড) যদি এতই জনপ্রিয় হন, তবে বিশ্বব্যাংক ছেড়ে রাজনীতিতে যোগদান করে নির্বাচনে দাঁড়াতে পারেন। তার এ কৌতুকপূর্ণ উক্তিটি হাল্কা ভেবে উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। কারণ গোল্ডস্টেইন যে পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে যথেষ্ট রাজনীতি করেছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে আশার কথা, বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের বর্তমান আবাসিক পরিচালক জোহান্স জুট একপর্যায়ে বলেন, ‘ষড়যন্ত্র ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে পদ্মা সেতু প্রকল্পে সহায়তা বাতিল করলেও বিশ্বব্যাংক মনে করে প্রকল্পটি বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এটা বাস্তবায়ন হওয়া উচিত। তাই আমরা প্রকল্পটি বস্তবায়নে সরকারকে পরোক্ষভাবে সহায়তা করে যাব।’ জোহান্স জুটির বিবৃতিটি পড়ে আমার মনে হয়েছে, ওই ক্রান্তিকালে গোল্ডস্টেইনের পরিবর্তে অন্য কেউ বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি থাকলে পদ্মা সেতুর পানি এতদূর গড়াত না।বিলম্ব হলেও শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধি দল যে রিপোর্ট দুর্নীতি কমিশনের চেয়ারম্যানকে প্রদান করেন, তা আদ্যপান্ত পাঠ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘রিপোর্টটি পড়ে আমার মনে হয়েছে দুর্নীতি হতে পারত, কিন্তু দুর্নীতি হয়নি।’একে সঠিক ধরে নিলে বলতে হয়, মার্ডার করা আর অ্যাটেম্পট টু মার্ডার- এক কথা নয়। খুনের বিচার হয় পেনাল কোডের ৩০২ ধারায়। এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড অথবা ন্যূনপক্ষে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আর অ্যাটেম্পট টু-মার্ডারের বিচার হয় পেনাল কোডের ৩০৭ ধারায়। এক্ষেত্রে শাস্তি যাবজ্জীবনও হতে পারে। আবার ক্ষেত্রবিশেষে বেকসুর খালাসও হতে পারে। তবে বিশ্বব্যাংক অ্যাটেম্পট-টু মার্ডারের দায়ে আমাদের ফাঁসিতেই ঝুলিয়ে দিল। আমাদের একটি কথা এখানে ভুলে গেলে চলবে না, দীর্ঘ পথপরিক্রমায় বিশ্বব্যাংকের হাতও সম্পূর্ণ পরিষ্কার ও স্বচ্ছ ছিল না। পরামর্শক নিয়োগের ব্যাপারে বিশ্বব্যাংক এমন এক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তদবির করেছিল, যে প্রতিষ্ঠানটি তার অপকর্মের জন্য বিশ্বের অনেক দেশেই ব্লাক লিস্টেড। কোনো নৈতিকতার বিচারেই বিশ্বব্যাংকের এমন একটি প্রতিষ্ঠান এমনকি কোনো ভালো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ওকালতি করার এখতিয়ার ছিল না। বিষয়টি ডামাডোলের মধ্যে ঢাকা পড়লেও একে উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই।আমরা জানি, ভারতের নন্দিত প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী একবার পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন আদালতের রায়ের কারণে। তার অপরাধ ছিল, তার প্রাইভেট সেক্রেটারি টেলিগ্রাম করে এলাহাবাদের ডিসিকে অনুরোধ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি নমিনেশন ফর্ম কিনে রাখার জন্য, কারণ তখন পার্লামেন্ট নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছিল। এলাহাবাদ হাইকোর্ট এ টেলিগ্রামটিকে ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রশাসনকে ব্যবহার করার অকাট্য প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করে। ফলে আদালতের রায়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইন্দিরা গান্ধীকে সরে যেতে হয়। এ রায় সম্পর্কে ব্রিটেনের একটি প্রভাবশালী পত্রিকায় লেখা হয়, ‘It is just giving death sentence to a person for mere violation of traffic signal.’আমাদের বেলায় কেবল দুর্নীতি করতে চাওয়ায় কিংবা দুর্নীতি করার ইচ্ছা মনে ছিল- এ ধরনের সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক বিবেচনায় এমন শাস্তি প্রদান করা হল, যাতে গোটা সরকার, দেশ ও জাতির আপদমস্তক কলংকের কালিমা লেপন করে দেয়া হল। বিনা দোষে একেবারে ফাঁসির কাষ্ঠে লটকিয়ে দেয়া হল গোটা জাতিকে। অর্থনীতির চেয়ে এখানে রাজনীতি বেশি কাজ করেছে, ষড়যন্ত্র কাজ করেছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার চেয়েও ‘ভিন্ন ধরনের’ রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের বিষয়টি এখানে গভীরভাবে কাজ করেছে। পরবর্তীকালে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলোই তার সুস্পষ্ট প্রমাণ।আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া : ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)
Posted on: Wed, 24 Jul 2013 22:55:12 +0000

Recently Viewed Topics




© 2015