লিঞ্চিং (lynching) শব্দটা - TopicsExpress



          

লিঞ্চিং (lynching) শব্দটা প্রথম পড়েছিলাম ক্লাস ফাইভ/সিক্সে পড়ার সময় ওয়েষ্টার্ন গল্পের বইয়ে। সোজা ভাষায় যার অর্থ হলো- extrajudicial/ extralegal murder by a mob. প্রায় বইয়েই লিঞ্চিংর ঘটনা থাকতো। বেশীরভাগ সময় প্রেক্ষাপট থাকতো cattle চুরির ঘটনা, আর লিঞ্চিং করা হতো চোর(rustler)-দেরকে। তবে অনেক সময় নিরপরাধ কাউকেও নানাকারণে যেখানে সেখানে কাউবয়রা দলবেঁধে মিলে ঝুলিয়ে মেরে ফেলার ঘটনাও থাকতো। ছোটবেলায় যতবার কোনো ওয়েষ্টার্ন বইয়ে লিঞ্চিংর ঘটনা পড়তাম, নিজেই ভয়ে কুঁকড়ে যেতাম। আর খালি ভাবতাম, আমরা কী সৌভাগ্যবান, একটা সভ্য সময়ে জন্ম নিয়েছি। আমাদের সমাজে এসব হয়না! এমেরিকায় কালোদের ইতিহাস পড়তে গিয়ে নতুন করে লিঞ্চিং শব্দটার সাথে দেখা। বেশীদিন আগে না, এই সত্তুর/আশি বছর আগেও এমেরিকায় প্রচুর কালো মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে লিঞ্চিং-এ। আমার মনে আছে, যে সামান্য কিছু ঘটনা পড়েছি তারমধ্যে Laura Nelson এর লিঞ্চিংর ঘটনা পড়ে বেশ কিছুদিন খুব distressed ছিলাম (ছবি প্রথম কমেন্টে)। খালি মাথায় ঘুরতো, কেমন লেগেছিলো লরার? যখন একদল উন্মত্ত সাদালোক মুখে কাপড় বেঁধে রাতের অন্ধকারে ওদেরকে জেল ভেংগে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যেতে যেতে উল্লাস করছিলো, যখন টানা-হেঁচড়ায় ভীড়ের ভিতর হাতিয়ে গিয়েছিলো তার বুকের শিশুটা, যখন তার জোয়ান ছেলের সামনেই তাকে সবাই মিলে যতক্ষন পারলো ধর্ষন করলো, তারপর মা আর ছেলে দুজনকেই চাবুক দিয়ে মারতে মারতে যখন আর মারার শক্তিও থাকলো না তখন প্রথমে ছেলেকে তারপর মাকে ব্রীজের উপর থেকে মোটা দঁড়ি বেধে ঝুলিয়ে দিলো। মরতে মরতে কী অভিশাপ দিয়েছিলো লরা তখন পৃথিবীকে? কী অভিযোগ করেছিলো খোদাকে? জীবনের কী অর্থ বুঝেছিলো সে ঠিক আত্মাটা বেরিয়ে যাওয়ার আগে? লরার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। অনেকদিন পর তার কথা নতুন করে মনে পড়েছিলো ২০০৬ এর ২৮ অক্টোবর। বাংলাদেশে প্রকাশ্যে রাস্তায় মিডিয়ার সামনে, দুনিয়ার সামনে, লিঞ্চিং করে মারা হলো চৌদ্দ-পনেরটা জোয়ান ছেলেকে। ওয়েষ্টার্ন গল্পের বইয়ে, বা এমেরিকার কালোদের ইতিহাসে কখনো পড়িনি লিঞ্চিং করে মেরে ফেলার পর লাশ নিয়ে আনন্দ করতে, লাশের উপর দাঁড়িয়ে নাচতে। কিন্তু বাংলাদেশ সেদিন দেখিয়ে দিলো পৃথিবীকে লিঞ্চিং করতে বাংলাদেশ পৃথিবীর সেরা। এখানে লিঞ্চিং করা হয় বড় বড় লাঠি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে, লাঠির আগা চিকন চিকন করে নিয়ে তা দিয়ে চোখে-মুখে-মাথায়-বুকে গুতিয়ে গুতিয়ে, প্রথমে লাথি-ঘুষি মেরে থেতলে নিয়ে তারপর ঘিরে ধরে নাচতে নাচতে ছুরি দিয়ে একটা একটা করে আঘাত করে করে [একটাও বানিয়ে বলছিনা, ইউটিউবে ২৮ অক্টোবর ২০০৬ এর ভিডিওগুলো দেখলে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাবে লিঞ্চিংর কদর্য নিষ্ঠুরতা দেখে] (ছবি দ্বিতীয় কমেন্টে)। সেদিনের পর আমি নিজেকে অনেক বুঝাতে চেষ্টা করেছিলাম আমার দেশ এমন না, আমার দেশের মানুষ এমন না। এটা ওয়ান-অফ ঘটনা। ঘটে গেছে। গড, প্লীজ, আমি এমন দেশে জন্ম নেইনি যেখানে মানুষ লিঞ্চিং করে আনন্দ পায়। ওসব সত্তুর/আশি বছর আগে হতো এমেরিকায়। প্লীজ, প্লীজ, এটা স্রেফ একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আমার আকুতি আকুতিই থেকে গেছে। ২০০৬ থেকে ২০১৪ তে আসতে আসতে বাংলাদেশীরা লিঞ্চিং কে সফেসটিকেটেড আর্টের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। কাউকে lynch করে মারার জন্য এখন আর সত্তুর/আশি বছর আগের সেই আমেরিকান কাউবয়দের মত ঘোড়া দাবড়িয়ে দৌঁড়ে ধরতে হয়না। এমনকি লোকেশানে ফিজিকালি না থেকেও এখন লিঞ্চিং-এ পার্টিসিপেট করা যায়, অনলাইনের মাধ্যমে (থ্যাংক্স টু টেকনলজিক্যাল এডভান্সমেন্ট!)। লিঞ্চিং করার জন্য এখনতো সরকারের নিজস্ব পুলিশ-সামরিক বাহিনীই আছে। মানুষকে স্রেফ অনলাইনে-অফলাইনে মব ক্রিয়েট করতে হয়, লিঞ্চিংর দাবী তুলতে হয়, ব্যাস! ফেইসবুকে নিজের প্রোফাইলে About me তে অনেকেই অনেক কিছু লিখে। ভয় হয়, কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো আমরা দেখবো কোনো বাংলাদেশী তার প্রোফাইলে খুব গর্ব করে লিখেছে আই এ্যাম আ ভার্চূয়াল লিঞ্চার!
Posted on: Mon, 20 Jan 2014 03:44:54 +0000

Trending Topics



Recently Viewed Topics




© 2015