সকাল ৬:৪৫টায় ফোনটা বেজে - TopicsExpress



          

সকাল ৬:৪৫টায় ফোনটা বেজে উঠলো। ঘুমঘুম চোখে রিসিভারটা তুলতেই ওপাশ থেকে জিজ্ঞেস করলো.... Hello! Is it Mr Paul? Yes. Morning. Could you please come at the 2nd floor? RILO meeting will be held here. Good Morning. The meeting is at 10. I’ll be there on time. Thank you. বলেই ফোনটা রেখে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। ভাবলাম, ব্রেকফাস্ট করতে ডাকছে বোধ হয়। এই মুহূর্তে ব্রেকফাস্ট করতে গিয়ে আরো ২ ঘণ্টার ঘুম নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। আর কেউ বিরক্ত করলো না। আরো দেড় ঘণ্টা আরাম করে ঘুমালাম। মোবাইলের ঘড়িতে যখন সোয়া ৮টা তখন চোখ রগড়াতে রগড়াতে উঠে রিস্ট ওয়াচে দেখি সোয়া ১১টা বাজে। কিছুই বুঝলাম না। ভাবলাম, গতকাল রাত থেকে ঘড়ি বন্ধ হয়ে আছে। রোমানসন’কে একগাদা গালাগালি করে বাথরুমে গিয়ে দেখি, রোমানসনের ভূত সেখানেও চেপেছে। এবার আর বুঝতে দেরি হলো না। মোবাইলের ঘড়িতে সময়টা ঠিক করা হয়নি। ওটা বাংলাদেশের সময়, ৩ ঘণ্টা পিছিয়ে। আমাদের দিনগুলো যেভাবে ঘড়ির ছকে বাঁধা তাতে মনে হয়, দরোজা-জানালা বন্ধ করা থাকলে ঘড়িতে ৬টা মানে সকাল ৬টা, নাকি রাত ৬টা, সেটা বোঝা মুশকিল। কতক্ষণ ঘুমাচ্ছি সেটার চাইতে বেশি জরুরি হলো, ঘড়িতে কয়টা বাজে। যে জীবন ঘড়িতে চলে, সে জীবন মাঝে মাঝে ঘড়িতেই থমকে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। এরপর শুরু হলো দৌড়। তাড়াহুড়ায় গাল কেটে শেভ করলাম। গায়ে কোনোরকমে স্যুটটা চাপিয়ে দিলাম দৌড়! আমার ভাগ্য ভালো আমরা যে হোটেলে উঠেছি সেমিনার সেটারই দোতলায়। প্রথম প্রেজেন্টেশনটা তখনও চলছিলো। আমি পৌঁছার ১০ মিনিট পর ওটা শেষ হলো। এরপর কফি ব্রেক। মিস লি’র সাথে দেখা করে সরি বলে বললাম, I’d a severe headache this morning. I’m really sorry that I missed the 1st part of the presentation. মিস লি কাজপাগল মানুষ। কাজ ছাড়া আর কিচ্ছু বোঝেন না। আমার এই মিথ্যেটা ধরতে পারলেন না। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, Oh! I’m sorry for you. Are you OK now? Please get the reimbursement of your airfare and other expenses. আমি তো মহাখুশি। ওরা প্লেনের ভাড়া থেকে শুরু করে সব খরচাপাতি দিয়ে দিলো। মিস লি এই অনুষ্ঠানের সবকিছু দেখাশোনার দায়িত্বে আছেন। খুব সিরিয়াস টাইপের মানুষ। উনাকে মেইল পাঠালে রিপ্লাই পেতে মাত্র বেশি হলে ২ ঘণ্টা লাগে। বিদেশিরা ইমেইলকে খুব গুরুত্ব দেয়। ওরা আমাদের মতো দিনক্ষণ দেখে শুভদিনে মেইলবক্স চেক করে না। কফি ব্রেকের সময় ফিজি থেকে আসা বিশালদেহি দ্রিসিকে কথায় কথায় বললাম, Brother, I regret missing the early part of the previous presentation. উনি সাথে সাথেই উত্তর দিলেন, Brother, I regret not missing it. You were lucky enough to have a headache. এইসব সেমিনারে প্রেজেন্টেশনগুলো সাধারণত খুব মজার কিছু হয় না। তবে WCO থেকে আসা প্রেজেন্টার ভদ্রমহিলাকে দেখার জন্য হলেও এই প্রেজেন্টেশন শোনা যায়। উনি ড’কে দ আর ট’কে ত উচ্চারণ করেন। এই যেমন তুদে’স সেমিনার উইল অ্যাড ……. কফি ব্রেকের পরেও উনিই প্রেজেন্টেশন দিলেন। দীর্ঘ প্রেজেন্টেশন! সুন্দরী মহিলার লেকচার শোনার সবচেয়ে বড় লাভ হলো কে কী ভাবছে এটার চিন্তা না করেই সুন্দরীর দিকে দীর্ঘ সময় ধরে ইচ্ছেমতো তাকিয়ে থাকা যায়। আমি লেকচার শুনছি আর আশেপাশে কে কী করছে দেখছি। আমার পেছনেই একটা মিষ্টি চেহারার কোরিয়ান কাস্টমস অফিসার বসেছিলো। অতি চঞ্চল মেয়ে! সারাক্ষণই হাতের আঙুলগুলো নাড়াচাড়া করতে থাকে। চোখে চোখ পড়লেই চোখ পিটপিট করে মাথা নড করে হ্যালো বলে। একটু দূরে বসে ছিলো থাইল্যান্ড থেকে আসা স্বচ্ছবসনা সুন্দরী। চোখ আর মন দুটোই ওদিকে চলে যায়। কোরিয়ান ছোটোখাট গড়নের মেয়েটা পাশের চীনা কিউট ছেলেটার সাথে কিচিরমিচির ভাষায় সারাক্ষণই বকবক করছে। আমার একপাশে বসেছিলেন মিস লি আরেক পাশে ভুটান থেকে আসা আরেক ডেলিগেট। আমি RILO’র দেয়া খাতায় কোরিয়া থেকে কী কী কিনবো সেটার লিস্ট করছিলাম আর আমার নিজের চোখ দুটো কীভাবে দুইদিকে উপরে টেনে ধরলে আমাকে কাইমুরার মতো দেখাবে, সেটা ভাবছিলাম আর খাতায় মজা করে ওসব লিখছিলাম। কাইমুরা জাপান থেকে এসেছে। ও ওই ছোটো ছোটো চোখে দেখে কীভাবে কে জানে! হঠাৎ পাশের লি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো, You’ve to make a presentation when you’re back to your country. So, you’re taking notes. Right? আমি ভাবলাম, এই সেরেছে রে! দ্রুত বাংলায় লেখা শুরু করে ওকে বললাম, Oh! Yes yes! I’m just taking important notes. লি Very good বলে আবার প্রেজেন্টেশনে মন দিলো। বাংলার অপার মাহাত্ম্যে আমি মুগ্ধ হলাম। লি যদি এখন আমার কাছ থেকে খাতাটা চেয়েও বসে, তাতেও কোনো সমস্যা নাই। পুরো সেমিনার হলে আমি ছাড়া আর কেউ বাংলা জানে না। প্রেজেন্টেশন শেষে ডিসকাশন পার্টে প্রেজেন্টার ভদ্রমহিলা প্রেজেন্টেশন থেকেই একটা প্রশ্ন করলেন। কম্পিউটার ডাটাবেজ নিয়ে পড়াশোনা থাকলে প্রশ্নটার উত্তর করতে সহজ হয়। অনেকে অনেকভাবে এটার উত্তর দিলো। আমারটা শুনে উনি বললেন, This method could be more effective if implemented. You’re from Bangladesh, right? Bangladeshi officers are cool! সবাই করতালি দিলো। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভালোকিছু শুনতে পারাটা অনেক বড় কিছু। ওই সময়ে কী যে আনন্দ হচ্ছিলো, সেটা বলে বোঝানো যাবে না। আমি কখনোই ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইনি, হইনিও; এটা নিয়ে যতোটা খুশি ছিলাম, তার চেয়ে আজকে অনেকবেশি খুশি হলাম, আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছিলাম, এটা ভেবে। প্রিয় চুয়েট, আমি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হলে লোকে আমাকে দেখিয়ে তোমাকে যতোটা সাদামাটা ভাবতো, এখন তার চেয়ে অনেকবেশি গর্জিয়াস ভাবে আমি ইঞ্জিনিয়ার হইনি বলে। তোমাকে ধন্যবাদ। তুমি এই অধমকে এখনো সম্মানিত করে যাচ্ছো। শেষের প্রেজেন্টার এ্যাঁ উঁ অঁ করে কোরিয়ান ভাষায় ইংরেজি বলেটলে কোনোরকমে স্টেজ ছেড়ে পালালো। ওর প্রেজেন্টেশনের সবচাইতে বোধগম্য ইংরেজি ছিলো, একেবারের শেষের থ্যাঙ্ক য়্যু’টা। ইংরেজি বলার অদক্ষতা কিন্তু বাঙালি মাত্রেরই একক সম্পত্তি নয়। আজকে রাতে কোরিয়ান কাস্টমসের সৌজন্যে একটা ওয়েলকামিং ডিনারের আয়োজন করা হয়েছিলো। লাঞ্চে আর ডিনারে মোটামুটি পরাক্রমশালী অক্টোপাস থেকে শুরু করে নিরীহ বিস্কিট পর্যন্ত সবই ছিলো। বাঙালির ভাতের চিহ্ন ছিলো শুধুই ৮ রকমের কোরিয়ান সুসিতে। সি-ফুডের প্রাধান্য ছিলো দেখার মতো। শামুক-ঝিনুক-স্টার ফিশ-স্কুইড-টুনা ফিশ-মমের লাঞ্চন গল্পের স্যালমন ফিশ আরো বিচিত্র সব আইটেম। অনেক খাবারের নামও শুনিনি কখনোই। ব্যুফে খাওয়া শুরু হয়েছিলো রেড ওয়াইন দিয়ে, শেষ হলো কফিতে। আমি মোটামুটি সব আইটেমই টেস্ট করেছি। খাবার টেস্ট করার ধরণে নিজেকে মিস্টার বিন মিস্টার বিন লাগছিলো। কোরিয়ান মেয়েটা আমার কাণ্ড দেখে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসলো, তুমি যে সবকিছু খেয়ে ফেলছো, তোমার গড তোমাকে বকবে না? তোমাকে কী অনেক কান্নাকাটি করতে হবে ক্ষমা পাওয়ার জন্যে? আমি বললাম, না বকবে না। আমার সাথে আমার গডের রিলেশন ভালো। আমিও উনার কোনো কাজে মাইন্ড করি না, উনিও আমার কোনো কাজে মাইন্ড করেন না। এটা শুনে ও কিচিরমিচির করে হাসতে লাগলো। বললো, না, আমি শুনেছি, তোমার দেশের গড খুব রাগি। কিছু করলেই কঠিন কঠিন সব শাস্তি দিয়ে বসেন। ভাবতে লাগলাম, ইসশ! এই মেয়েটা এতো কিউট কেনো? এর মধ্যে কয়েকজন এসে আমার খোঁজখবর নিলেন। লি ওর কয়েকজন কলিগকে বলে দিয়েছিলো, বাংলাদেশ থেকে আসা মিস্টার পল আজকে সকালে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, এখন আমি কেমন বোধ করছি। লি’র বসও এসে জিজ্ঞেস করলো, আমার কোনো মেডিসিন লাগবে কিনা, আমার রুমে ডক্টর পাঠাবে কিনা। ওদের সারল্য, আন্তরিকতা, বিনয়, আতিথেয়তা, সততা মুগ্ধ করার মতো। লি ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি যে আমি মিথ্যে বলেছি। ওদের মাথায়ই এটা আসে না যে কেউ এটা নিয়ে মিথ্যে বলতে পারে। ওরা যেটার দায়িত্ব নেয় সেটার যত্ন নিতে জানে। মিথ্যে বলা, ঠকানো, চুরি করা, ফাঁকি দেয়া এইসব ওদের মধ্যে নেই। আজকে লি’র সাথে মিথ্যে বলে আমার যতোটা আফসোস হয়েছে, সেটা আমার জীবনের সব সত্য বলতে পারার তৃপ্তির চাইতেও বেশি। কাউকে হাজারটা মিথ্যে বিশ্বাস করানোর কষ্টের চাইতে ওর একটা মিথ্যে বিশ্বাস করার সারল্য বেশি কষ্ট দেয়। প্রচণ্ড লজ্জা আর অনুতাপ আমাকে ছেয়ে ফেলেছিলো। আমি মনে মনে ঠিক করেছি, আর কখনোই কোনো কোরিয়ানের সাথে মিথ্যে বলবো না। জাপানি ছেলেটার সারল্যও মনে রাখার মতো। ও আমার সাথে কথা বলে এতোটাই মুগ্ধ, ও আমাকে টোকিও যাওয়ার টিকেট পর্যন্ত পাঠাতে চেয়েছিলো। রাতের খাবার খাওয়ার সময় ইন্সট্রুমেন্টাল শো’র আয়োজন করা হয়েছিলো। তিনজন নিখুঁত সৌন্দর্যের কোরিয়ান তরুণী খাইয়াকুমে ওখানকার পুরোনো ঐতিহ্যবাহী অপূর্ব সুর তুলে আজকের সন্ধ্যাটাকে স্বপ্নের আবেশে জড়িয়ে দিয়েছিলো। যন্ত্রটা বাজানো বেশ কঠিন। ওদের বাজানোর প্রতি যত্ন আর পেশাদারিত্ব যেনো পুরো কোরিয়ার সমৃদ্ধির চাবিকাঠির খোঁজ দেয়। রুমে ফিরলাম ৯টার পর। ফিরে চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেলো। আমার বিছানাটা খুব সুন্দর করে গোছানো, টেবিলে নতুন পানির বোতল রাখা আছে, এলোমেলো প্যান্টশার্টগুলো কে যেন গুছিয়ে রেখে গেছে। রুমে জিনিসপত্র ছড়ানো অবস্থায় নেই, কেউ একজন আমার অনুপস্থিতিতে পুরো রুমটাকে ঝকঝকে করে রেখে গেছে। আমার ডলারের খামটা যেমন ছিলো তেমনই টেলিফোনের পাশে আছে। ভেতরের ৭৫০ ডলারও ঠিকঠাক আছে। পাসপোর্টটাও ঠিক আছে। আমার রুমে একটা সিকিউরিটি লক আছে। সেটাতে আজকে তাড়াহুড়ায় কিছু রেখে যাইনি। জগতের সকল অসৎ লোক মিলে তালা ব্যবসায়ীদের প্রমোট করে। যে লোকটা রুম চেক করতে এসেছিলো, সে একটা দামি জিনিসও সরায়নি। কোরিয়া, জাপান এইসব দেশের মানুষ কোনো ধর্মীয় আচারআচরণ পালন করে না। ধর্মের মূলকাজগুলো কিন্তু ওরা ঠিকভাবেই করে। আমরা মৃত্যুর পর বেহেস্তে যাওয়ার আশায় ধর্ম পালন করি, আর ওরা বেহেস্তে মৃত্যুর আশায় ধর্ম পালন করে। আমাদেরটা যতোটা আরোপিত, ওদেরটা ততোধিক স্বতঃস্ফূর্ত।
Posted on: Tue, 16 Sep 2014 16:42:33 +0000

Trending Topics



Recently Viewed Topics




© 2015