চেতনার খাম্বাসমূহ - TopicsExpress



          

চেতনার খাম্বাসমূহ #০১ ========== ... আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা ইসলামবিরোধী ছিল না। কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে হঠাৎ হল কি, নজরুল ইসলাম তখন আমাদের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। যখন যশোরের কিছু অঞ্চল মুক্ত হল। সেখানে এরা গেলেন। আমার যাওয়ার কথা ছিল, আমি যেতে পারিনি। সেখানে তিনি হঠাৎ ঘোষণা দিলেন, কারও সঙ্গেই পূর্বাহ্নে কোন আলোচনা না করে ঘোষণা দিলেন, এখন থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের দেশের একটা আদর্শ হল এবং আমরা মুসলিম লীগ ব্যান্ড করে দিলাম। মোহামেডান স্পোর্টিং এর মোহামেডান শব্দটা ব্যান্ড করে দিলাম। ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনি আকস্মিকভাবে ঘোষণা করলেন। আমার মনে আছে, ভারতের শিক্ষামন্ত্রী আলীগড় ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ছিলেন। নুরুল হাসান, তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর - ১৯৭২ সালে। তখন ইতিমধ্যে আমরা সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের নাম সলিমুল্লাহ হল করেছি। জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুসলিম বাদ দিয়েছি। সব জায়গা থেকে মুসলিম ব্যান্ড। যাই হোক। তিনি ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের বাসায় নৈশভোজে মিলিত হয়েছিলেন। নৈশভোজ শেষে তিনি আমাকে একটু আলাদা ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন - ভারত তো ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, কন্সটিটিউশনে আছে। তোমরাও তোমাদের কন্সটিটিউশনে ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়েছ, ঠিক আছে। ভারত তো আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির নাম মুসলিম রেখেছে। বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির হিন্দু রেখেছে। তাহলে তোমরা এ কাজগুলো করতে গেলে কেন? এটাতো ইতিহাসকে বিকৃত করা। সলিমুল্লাহর টাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় হযেছে, সেখানে সলিমুল্লাহর সাথে মুসলিম শব্দ যুক্ত হয়ে থাকে এটাও ইতিহাসের বিশেষ ক্ষণে হয়েছিল। তুমি এই সময় সেই ইতিহাসকে মুছে দাও কি করে? আমার কোন উত্তর দেয়ার ছিল না। এ কাজতো আমরা করেছি। আমরা তো অসম্ভব নাম বদলাই। নাম বদলে আনন্দ পাই। নাম বদলে মনে করি, এই নাম বদলানোটা চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে। কিন্তু নাম বদলানো কখনো চিরস্থায়ী হয় না। করাচীতে যারা গিয়েছেন তারা বলবেন, যেখানে গান্ধীজি আশ্রম করেছিলেন কংগ্রেস সম্মেলনের সময় সেই গান্ধী গার্ডেন, এখনো গান্ধী গার্ডেন। মতিলাল নেহরু যে বাড়িতে ছিলেন সেই রাস্তার নাম মতিলাল নেহরু রোড, এখনো আছে। বম্বেতে পিপলস জিন্নাহ হল, এখনো আছে। আমরা কেন এগুলো পাল্টালাম? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালযে উর্দু বিভাগ খোলা হয়। উর্দু চেয়ার একটা করা হযেছে এবং ফয়েজ আহমদ ফয়েজকে ইকবাল প্রফেসর অব উর্দু করা হয়। ইন্ডিয়াতে ইকবাল দিবস পালিত হয়, ইকবালকে বিরাট কবি হিসেবে গণ্য করা হয় এবং ইকবালের ওপর বই ইন্ডিয়া থেকে বের হচ্ছে, পন্ডিতরা বের করছে ইংরেজিতে। আমরা সেই ইকবালকে, ইকবাল হলকে, ইকবালের নামই মুছে দিলাম। কি রকম মূর্খ আমরা। অবোধ বলব না, মূর্খ এবং অনাচারী। অনাচারী ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। ... প্রত্যেকেই আমরা দেখতে পাচ্ছি আমরা যারা ইসলামের কথা বলি তাই, ইসলামের কথাটাই বিশেষ করে ধরলাম। এটা একটা সেন্সেটিভ ইস্যু হয়ে গেছে। অথচ ইসলাম কোন সেনসেটিভ ইস্যু হওয়ার কথা না, আমি মুসলমানের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছি। আমি মুসলমান। আমি ইসলামকে জানবার চেষ্টা করব, এটা তো স্বাভাবিক। কিন্তু যারা ইসলামের নামে সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে তারা নিজেরা বৌদ্ধ ধর্মও তো গ্রহণ করেনি। হিন্দুও হয়ে যেতে চাচ্ছে না। খ্রিস্টানও হচ্ছে না। কোন কিছু হচ্ছে না। মুসলমান থাকছে। তার মধ্যে আবার ইসলামের বিরুদ্ধে বলা এটা একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার আমার কাছে মনে হয়। একটা অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া মনে হয়। সুতরাং এটা মনে হচ্ছে, অনেক সময় হয় কি আমি জিনিসটা আরেকটু ভালভাবে বোঝাবার চেষ্টা করছি - আমি অনেককে দেখেছি বয়স যাদের বেশি হয়ে যায়, এরকম কিছু লোক পরে, মৃত্যুর পর আর জীবিত থাকবে না। সুতরাং তরুণদের কাছে নিজেকে গ্রহণীয় করবার জন্য অনেক কান্ড করে। এরকম কিছু প্রবীণরা আছে, অনেক কান্ড করে। আবুল ফজল এভাবে বাংলার বিবেক হয়েছিলেন। এনামুল হকও অনেক কান্ড করে গেছেন॥ - সৈয়দ আলী আহসান / মনীষার মুখ ॥ [ সম্পাদনা : আবদুল হাই শিকদার । ঝিঙেফুল - ফেব্রুয়ারী, ২০০৩ । পৃ: ৪০-৪৩ ] চেতনার খাম্বাসমূহ #০২ ========== ... জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার মহান আদর্শই আমাদের বীর জনগণকে মুক্তি-সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল। তথ্য হিসাবে কথাটা ঠিক না। আওয়ামী লীগের ছয়-দফা বা সর্বদলীয় ছাত্র একশন কমিটির এগার-দফার দাবিতেই আমাদের মুক্তি-সংগ্রাম শুরু হয়। এইসব দফার কোনটিতেই ঐ সব আদর্শের উল্লেখ ছিল না। ঐ দুইটি দফা ছাড়া আওয়ামী লীগের একটি মেনিফেস্টো ছিল। তাতেও ওসব আদর্শের উল্লেখ নাই। বরঞ্চ ঐ মেনিফেস্টোতে ব্যাংক-ইনশিওরেন্স, পাট ব্যবসা ও ভারি শিল্পকে জাতীয়করণের দাবি ছিল। ঐ দফা মেনিফেস্টো লইয়াই আওয়ামী লীগ ৭০ সালের নির্বাচন লড়িয়াছিল এবং জিতিয়াছিল। এরপর মুক্তি সংগ্রামের আগে বা সময়ে জনগণ, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের পক্ষ হইতে আর কোনও দফা বা মেনিফেস্টো বাহির করার দরকার বা অবসর ছিল না। আমাদের সংবিধান রচয়িতারা নিজেরা ঐ মহান আদর্শকে সংবিধানযুক্ত করিয়াছিলেন। তাই জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ঐ ভুল তথ্য পরিবেশন করিয়াছেন। রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের মতাদর্শকে জনগণের মত বা ইচ্ছা বলিয়া চালাইয়াছেন বহু বার বহু দেশে। সবসময়েই যে তার খারাপ হইয়াছে, তাও নয়। আবার সব সময়ে তা ভালও হয় নাই। পাকিস্তানের সংবিধানের বেলায় ইসলাম ও বাংলাদেশের সংবিধানের বেলায় সমাজতন্ত্র, জাতীয়তা ও ধর্ম-নিরপেক্ষতাও তেমনি অনাবশ্যকভাবে উল্লিখিত হইয়া আমাদের অনিষ্ট করিয়াছে। আমাদের জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বহু জটিলতার সৃষ্টি করিয়াছে। এসব জটিলতার গিরো খুলিতে আমাদের রাষ্ট্র-নায়কদের অনেক বেগ পাইতে হইবে॥ - আবুল মনসুর আহমদ / আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর ॥ [খোশরোজ কিতাব মহল - ডিসেম্বর, ১৯৯৯ । পৃ: ৬২০-৬২১] চেতনার খাম্বাসমূহ #০৩ ========== ... ৬ দফা বা আমাদের অর্থনৈতিক কর্মসূচী ইসলামকে বিপন্ন করে তুলেছে বলে যে মিথ্যা প্রচার চালানো হচ্ছে - সে মিথ্যা প্রচারণা থেকে বিরত থাকার জন্য আমি শেষবারের মত আহবান জানাচ্ছি। অঞ্চলে অঞ্চলে এবং মানুষে মানুষে সুবিচারের নিশ্চয়তা প্রত্যাশী কোনকিছুই ইসলামের পরিপন্থী হতে পারে না। আমরা এ শাসনতান্ত্রিক নীতির প্রতি অবিচল ওয়াদাবদ্ধ। কোরাণ ও সুন্নাহর নির্দেশিত ইসলামী নীতির পরিপন্থী কোন আইন এদেশে পাশ হতে বা চাপিয়ে দেয়া যেতে পারে না॥ - শেখ মুজিবুর রহমান / রেডিও পাকিস্তান থেকে প্রচারিত ভাষণ - ১০.১০.১৯৭০॥ মুজিবরের রচনা সংগ্রহ ॥ [ প্রকাশক: সোমেন পাল। রিফ্লেক্ট পাবলিকেশন। কলিকাতা। জুন, ১৯৭১। পৃ: ৫৫] চেতনার খাম্বাসমূহ #০৪ ========== ... প্রথম ঘটনাটা ঘটিল স্বাধীনতার প্রায় শুরুতেই - ১৮ই ডিসেম্বর। ঐ দিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা উদযাপনের জন্য দিল্লির রামলীলা ময়দানে এক বিরাট জনসভা হইল। সে সভায় ভারতের দেশরক্ষা মন্ত্রী শ্রী জগজীবনরাম বক্তৃতায় বলিলেন : এতদিন পাকিস্তানের গর্বের বিষয় ছিল, সে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র। গত পরশু হইতে সে গৌরব বর্তাইয়াছে বাংলাদেশের উপর। বাংলাদেশই এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র। আকাশবাণীর খবর অনুসারে মি: রামের এই উক্তি সেই বিরাট জনসভায় বিপুলভাবে অভিনন্দিত হইয়াছিল। কিন্তু বাংলাদেশের সদ্য-দীক্ষিত একজন অফিসার মি: রামের ঐ উক্তির তীব্র প্রতিবাদ করিয়া বলিলেন : মি: রামের স্মরণ রাখা উচিৎ ছিল বাংলাদেশ একটি সেকিউলার রাষ্ট্র, মুসলিম রাষ্ট্র নয়। আমি বুঝিলাম এটা যদি বাংলাদেশ সরকারের সরকারী অভিমত হয়, তবে বিপদের কথা। বাংলাদেশের পরিচালন-ভার এমন সব অতি প্রগতিবাদী লোকের হাতে পড়িতেছে যারা ইসলামী রাষ্ট্র ও মুসলিম রাষ্ট্রের পার্থক্য বুঝেন না বা বুঝিতে চাহেন না। প্রবাসী সরকার ঢাকায় ফিরার সংগে সংগে প্রমাণিত হইল যে এটি সরকারী অভিমত। দেশে ফিরিয়াই তারা যা দেখাইলেন, তাতে রেডিও-টেলিভিশনে কোরান-তেলাওয়াত, খোদা হাফেয, সালামালেকুম, বন্ধ হইয়া গেল। তার বদলে সুপ্রভাত, শুভ সন্ধ্যা, শুভরাত্রি ইত্যাদি সম্বোধন প্রথা চালু হইল। মুসলমানদের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হইল। গুজব রটিতে লাগিল, আযান নিষিদ্ধ হইয়া যাইবে। কেউ বলিলেন: অমুক জায়গায় জন-সভায় বক্তৃতা চলিবার সময় নিকটস্থ মসজিদ হইতে আযান দিতে গিয়া মুয়াজ্জিন সাহেব বাধাপ্রাপ্ত হইয়াছেন। যথা-সম্ভব নেতৃস্থানীয় লোকজনকে ব্যাপারটা জানাইলাম। তারা আযানের ব্যাপারটা ভিত্তিহীন জানাইলেন। কিন্তু রেডিও টেলিভিশনের ব্যাপারটায় তর্ক জুড়িলেন। আমাদের আশংকা দৃঢ় হইল। দুশ্চিন্তা বাড়িল। - আবুল মনসুর আহমদ / আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর ॥ [খোশরোজ কিতাব মহল - ডিসেম্বর, ১৯৯৯ । পৃ: ৫৯৩-৫৯৪] - Kai Kaus
Posted on: Sun, 30 Nov 2014 19:59:35 +0000

Recently Viewed Topics




© 2015