বারমুডা ট্রায়াঙ্গলঃ - TopicsExpress



          

বারমুডা ট্রায়াঙ্গলঃ রহস্যঘেরা শয়তানের ত্রিভূজ বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল আলোচিত ও সমালোচিত এক রহস্যঘেরা অঞ্চল যাকিনা শয়তানের ত্রিভূজ নামেও পরিচিত, এটি আটলান্টিক মহাসাগরের একটি বিশেষ অঞ্চল, যেখানে বেশ কিছু জাহাজ ও উড়োজাহাজ রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ হওয়ায় কথা বলা হয়। অনেকে মনে করেন ঐ সকল অন্তর্ধানের কারণ নিছক দূর্ঘটনা, যার কারণ হতে পারে প্রাকৃতিক দূর্যোগ অথবা চালকের অসাবধানতা। আবার চলতি উপকথা অনুসারে এসবের পেছনে দায়ী হল কোন অতিপ্রাকৃতিক কোন শক্তি বা ভিনগ্রহের কোন প্রাণীর উপস্থিতি। তবে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য রয়েছে যে , যেসব দূর্ঘটনার উপর ভিত্তি করে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলকে চিহ্নিত করা হয়েছে তার বেশ কিছু ভুল, কিছু লেখক দ্বারা অতিরঞ্জিত হয়েছে এমনকি কিছু দূর্ঘটনার সাথে অন্যান্য অঞ্চলের দূর্ঘটনার কোনই পার্থক্য নেই। কিন্তু তবুও কাহিনী ধূম্রজালে জড়িয়েছে অনেক, তৈরি হয়েছে নানা মিথ এবং এই সময়েও বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নিয়ে আগ্রহের কোন কমতি নেই মানুষের মনে। বারমুডা ট্রায়াঙ্গল যে তিনটি প্রান্ত দ্বারা সীমাবদ্ধ তার এক প্রান্তে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা, আরেক প্রান্তে পুয়ের্তোরিকো এবং অপর প্রান্তে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বারমুডা দ্বীপ অবস্থিত। ত্রিভুজাকার এ অঞ্চলটি মোট আয়তনে ১১৪ লাখ বর্গ কিলোমিটার বা ৪৪ লাখ বর্গমাইল। এটি ২৫-৪০ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ এবং ৫৫-৫৮ ডিগ্রি পশ্চিম দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত। তবে বেশিরভাগ লেখক-গবেষকই এই নির্দিষ্ট অঞ্চলকে চিহ্নিত করেছেন সীমানা বরাবর মায়ামি, সানজুয়ান, পুয়ের্তোরিকো, মধ্য আটলান্টিক আর বারমুডা নিয়ে তৈরি একটি ট্রাপিজিয়াম আকৃতির চতুর্ভুজ হিসেবে। তবে লিখিত বর্ণনায় যে সাধারণ অঞ্চলের ছবি ফুটে ওঠে তাতে রয়েছে ফ্লোরিডার আটলান্টিক উপকূল, সানজুয়ান, পুয়ের্তোরিকো, মধ্য আটলান্টিকে বারমুডার দ্বীপপুঞ্জ এবং বাহামা ও ফ্লোরিডা রাজ্যের দক্ষিণ সীমানা। আর এখানেই ঘটেছে অধিকাংশ দুর্ঘটনা এবং তৈরি হয়েছে নানা মিথ। তবে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা বা নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাগুলো ঘটেছে দক্ষিণ সীমানায় বাহামা দীপপুঞ্জকে ঘিরে এবং ফ্লোরিডা উপকূলের আশপাশের কিছু অঞ্চলে। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের ওপর দিয়ে বয়ে যায় মেক্সিকো উপসাগর থেকে উষ্ণ সমুদ্র স্রোত। এখানকার আবহাওয়া এমন যে, শান্ত প্রকৃতির মাঝে হঠাৎ তুমুল ঝড় ওঠে, চারদিক ঘোর অন্ধকারে ঢেকে যায় আবার হঠাৎ করেই সব থেমে যায়। এছাড়া গ্রীষ্মে ঘূর্ণিঝড় তো নিয়মিত ব্যাপার। তবু এ অঞ্চলে ভারী বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলকারী পথগুলোর অন্যতম। জাহাজগুলো সাধারণত আমেরিকা, ইউরোপ ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে যাতায়াত করে। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের আকাশ পথ দিয়ে বিভিন্ন রুটে বাণিজ্যিক ও ব্যক্তিগত বিমান চলাচল করে। এ অঞ্চলের রহস্যময়তার একটি দিক হল, সমুদ্রগামী কোন জাহাজ বা উড়োজাহাজ এ ত্রিভুজ এলাকায় প্রবেশ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই বেতার তরঙ্গ হারিয়ে ফেলে, যার ফলে তারা উপকূলীয় কোন স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে না। কম্পাস উল্টাপাল্টা দিকনির্দেশনা দিতে থাকে। একসময় জাহাজ দিকনির্ণয় করতে না পেরে পথ হারিয়ে ফেলে এবং রহস্যজনকভাবে অদৃশ্য হয়ে যায়। মার্কিন নেভির সূত্র অনুযায়ী, গত ২০০ বছরে এ এলাকায় কমপক্ষে ৫০টি বাণিজ্যিক জাহাজ এবং ২০টি বিমান চিরতরে অদৃশ্য হয়ে গেছে। এর মধ্যে ১৯৬৮ সালের মে মাসে হারিয়ে যাওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক ডুবোজাহাজের ঘটনাটি সারা বিশ্বে সবচাইতে বেশি আলোড়ন তুলেছিল। ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্টের পাঁচটি বোমারু বিমান প্রশিক্ষণ চলাকালীন হারিয়ে যায়। হারিয়ে যাবার মুহূর্তে বৈমানিকদের একজন অতি নিম্ন বেতার তরঙ্গ পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার এই বেতার বার্তাতে বারবার একটি কথাই বলা হচ্ছিল, “সামনে প্রচণ্ড কুয়াশা। আমরা কিছু দেখতে পাচ্ছি না। কোথায় যাচ্ছি তাও বুঝতে পারছি না। আমাদের উদ্ধার করো”। এ বার্তা পাওয়ার পরপরই মার্কিন বিমান বাহিনীর একটি উদ্ধারকারী টিম এ অঞ্চলের দিকে রওনা হয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে তারাও নিখোঁজ হয়ে যায়। এভাবে এ এলাকায় এখন পর্যন্ত প্রায় ১৫০০ লোক প্রাণ হারিয়েছে বলে মনে করা হয়। সবচাইতে আশ্চর্যের বিষয় হল, হারিয়ে যাওয়া এসব যানগুলোর কোনও ধ্বংসাবশেষ পরবর্তীকালে অনেক খুঁজেও পাওয়া যায়নি। এর রহস্য উদঘাটনে বিভিন্ন সময়ে বেতার তরঙ্গের অনুপস্থিতির কথা বলা হলেও কোনও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি এখন পর্যন্ত। মার্কিন সামরিক বাহিনী এ এলাকায় বেশ কিছু গবেষণা চালিয়েও তেমন কোনও তথ্য উদ্ধার করতে পারেনি। অনেকে মনে করেন, নাবিকদের ভাষ্য অনুযায়ী এ এলাকায় মাঝে মাঝে বেতার তরঙ্গ হয়তো হারিয়ে যায়, তবে তা সবসময়ের জন্য নয়। কারণ পৃথিবীর কোনও এলাকায় স্বাভাবিক বেতার তরঙ্গের প্রবাহ হারিয়ে যেতে বা নিশ্চিহ্ন হতে পারে না। তাহলে সারা পৃথিবীর বেতার সিস্টেমই ধ্বংস হয়ে যাবে। গবেষকরা হারিয়ে যাওয়া যানের ধ্বংসাবশেষ না পাওয়ার যে ব্যাখ্যাটি দিয়ে থাকেন তা হল, আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যে একটি অন্যতম গভীর স্থান হচ্ছে এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গল। এমনকি আধুনিক ও প্রশিক্ষিত ডুবুরি সরঞ্জাম দিয়ে এই অঞ্চলে উদ্ধার কাজ চালানো এখনও অসম্ভব। স্যাটেলাইট প্রযুক্তির কারণে ধ্বংসাবশেষ কোথায় আছে তা হয়তো জানা সম্ভব, কিন্তু সেগুলো উদ্ধার করা ততটাই কঠিন। ফলে এ এলাকায় কোনও ধ্বংসাবশেষ নাও পাওয়া যেতে পারে। প্রকৃতির খেয়ালের এক অদ্ভুত উদাহরণ হচ্ছে এ স্থান। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল বিষয়ে যারা লিখেছেন তাঁদের মতে ক্রিস্টোফার কলম্বাস সর্বপ্রথম এই ত্রিভূজ বিষয়ে অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা লিখেন। তিনি লিখেছিলেন যে তাঁর জাহাজের নাবিকেরা এ অঞ্চলের দিগন্তে আলোর নাচানাচি, আকাশে ধোঁয়া দেখেছেন। এছাড়া তিনি এখানে কম্পাসের উল্টাপাল্টা দিক নির্দেশনার কথাও বর্ণনা করেছেন। তিনি ১১ই অক্টোবর ১৪৯২ তে তাঁর লগ বুকে লিখেন – The land was first seen by a sailor (Rodrigo de Triana), although the Admiral at ten oclock that evening standing on the quarter-deck saw a light, but so small a body that he could not affirm it to be land; calling to Pero Gutiérrez, groom of the Kings wardrobe, he told him he saw a light, and bid him look that way, which he did and saw it; he did the same to Rodrigo Sánchez of Segovia, whom the King and Queen had sent with the squadron as comptroller, but he was unable to see it from his situation. The Admiral again perceived it once or twice, appearing like the light of a wax candle moving up and down, which some thought an indication of land. But the Admiral held it for certain that land was near... বর্তমানে বিশেষজ্ঞরা প্রকৃত লগবুক পরীক্ষা করে যে মত দিয়েছেন তার সারমর্ম হল – নাবিকেরা যে আলো দেখেছেন তা হল স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ব্যবহৃত নৌকায় রান্নার কাজে ব্যবহৃত আগুন, আর কম্পাসে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল নক্ষত্রের অবস্থান পরিবর্তনের কারণে। ১৯৫০ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর ই. ভি. ডব্লিউ. জোন্স ( E.V.W. Jones) সর্বপ্রথম এ ত্রিভূজ নিয়ে খবরের কাগজে লিখেন। এর দু বছর পর ফেইট (Fate)ম্যাগাজিনে জর্জ এক্স. স্যান্ড( George X. Sand) “সী মিস্ট্রি এট আওয়ার ব্যাক ডোর” (Sea Mystery At Our Back Door) শিরোনামে একটি ছোট প্রবন্ধ লিখেন, এ প্রবন্ধে তিনি ফ্লাইট নাইনটিন( ইউ এস নেভী-র পাঁচটি “টি বি এম অ্যাভেন্জার” বিমানের একটি দল, যা প্রশিক্ষণ মিশনে গিয়ে নিখোঁজ হয়) এর নিরুদ্দেশের কাহিনী বর্ণনা করেন এবং তিনিই প্রথম এই অপরিচিত ত্রিভূজাকার অঞ্চলের কথা সবার সামনে তুলে ধরেন। ১৯৬২ সালের এপ্রিল মাসে ফ্লাইট নাইনটিন নিয়ে আমেরিকান লিজান (American Legion) ম্যগাজিনে লিখা হয়। বলা হয়ে থাকে এই ফ্লাইটের দলপতি কে নাকি বলতে শোনা গিয়েছে- We dont know where we are, the water is green, no white। এর অর্থ হল আমরা কোথায় আছি জানি না, সবুজ বর্ণের জল, কোথাও সাদা কিছু নেই। এতেই প্রথম ফ্লাইট নাইনটিনকে কোন অতিপ্রাকৃতিক ঘটনার সাথে যুক্ত করা হয়। এরপর ভিনসেন্ট গডিস (Vincent Gaddis) “প্রাণঘাতী বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল”( The Deadly Bermuda Triangle) নামে আর এক কাহিনী ফাঁদেন ১৯৬৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। এর উপর ভিত্তি করেই তিনি আরও বিস্তর বর্ণনা সহকারে লিখেন ইনভিজিবল হরাইজন (Invisible Horizons) মানে “অদৃশ্য দিগন্ত” নামের বই। আরও অনেক লেখকই নিজ নিজ মনের মাধুরী মিশিয়ে এ বিষয়ে বই লিখেন, তাঁরা হলেন জন ওয়ালেস স্পেন্সার, তিনি লিখেন লিম্বো অফ দ্যা লস্ট (Limbo of the Lost, 1969, repr. 1973), মানে “বিস্মৃত অন্তর্ধান”, চার্লস বার্লিটজ (Charles Berlitz) লিখেন “দি বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল”(The Bermuda Triangle, 1974), রিচার্ড উইনার লিখেন দ্যা ডেভিলস ট্রায়াঙ্গেল “শয়তানের ত্রিভূজ” (The Devils Triangle, 1974) নামের বই, এছাড়া আরও অনেকেই লিখেছেন। এরা সবাই ঘুরেফিরে একার্ট ( Eckert) বর্ণিত অতিপ্রাকৃতিক ঘটানাই বিভিন্ন স্বাদে উপস্থাপন করেছেন। বারমুডা ট্রায়াঙ্গল অঞ্চলে ৩০০’র বেশি কোরাল দ্বীপ রয়েছে। বারমুডা ছাড়া প্রায় সব দ্বীপই জনবসতিহীন। ১৫৬৫ সালে এক দুঃসাহসী নাবিক “জুয়ান ডি বারমুডেজ” এ দ্বীপটি আবিষ্কার করেন। তার নামানুসারেই দ্বীপটির নাম রাখা হয় বারমুডা। এ এলাকার ধার ঘেঁষে গেলেও দেখা যায় অদ্ভুত কিছু কান্ডকারখানা। মাঝে মাঝে নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কাজ করে না এখানে, রেডিও বিকল হয়ে যায়, কম্পাস ভুল নির্দেশনা দিতে থাকে, ক্ষুদ্র আলোক শিখা, ধূমকেতুর পুচ্ছ, সবুজ রঙের কুয়াশা, বিদঘুটে জলস্তম্ভ, প্রচন্ড ঘূর্ণিপাক, পথ ভুলে যাওয়া, হিংস্রভাবে জাহাজ গিলতে আসা পাহাড়সম ঢেউসহ ভয়ঙ্কর সব কান্ডকারখানার রহস্যে ঘেরা রয়েছে এ অঞ্চলটি। আবার আগে যে জাহাজ এখানে এসে হারিয়ে গেছে সে জাহাজকেও ভুতুড়েভাবে ভাসতে দেখা গেছে এখানে। এমন আরও কিছু ভুতুড়ে ঘটনার কথা বলা যাক। ১৯১৮ সালে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে ইউএস নেভির কয়েকটি জাহাজ নিখোঁজ হয়ে যায়। এগুলোর কোনটিরই আজ পর্যন্ত কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। এদের মাঝে সবচেয়ে বড় ও বিখ্যাত ছিল ‘সাইক্লোপাস’ নামের একটি জাহাজ। এতে যাত্রী ছিল ৩০৯ জন। ১৯ হাজার টন ওজনের এ ভারী জাহাজটি বারবাডোস হতে বল্টিমোরের দিকে যাত্রা করেছিল। বারমুডা ট্রায়াঙ্গালে এসে সাইক্লোপাস অদৃশ্য হয়ে যায়। কোথায় গেল সে জাহাজ? এবং জাহাজের ৩০৯ জন মানুষ? সেটি আজও রহস্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। “এলেন অস্টিন’ জাহাজটির কথাই ধরা যাক। মধ্য আটলান্টিক পাড়ি দেয়ার সময় এলেন অস্টিন জাহাজের নাবিকেরা একটু দূরে একটি খালি জাহাজ ভাসতে দেখেন, যার সম্পর্কে এর আগে তাদের কোন ধারণা ছিল না। ক্যাপ্টেনের কাছে অবাক লাগল যে, জাহাজটির ডেকে বা কোথাও কোন মানুষের দেখা নেই। তিনি চিন্তিত হলেন এবং কৌতূহলবশত ভাবলেন কিছু ক্রু পাঠিয়ে একটু দেখে আসা যাক। ক্রুরা খালি ভুতুড়ে জাহাজের কাছাকাছি পৌঁছতেই ঘন কুয়াশায় চারদিক ঢেকে গেল। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কি হল? কিছু বোঝাও যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে কুয়াশা কেটে গেল। আবার খালি জাহাজ দেখা গেল। কিন্তু পাঠানো ক্রুরা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। তারা কেউ আর জাহাজে ফিরে আসেনি। ঘটনার রহস্য সমাধান করতে আরও একটি দলকে পাঠানো হল। ওই দলটিও জাহাজে পৌঁছামাত্র শুরু হল প্রচন্ড ঝড়। এবারও কিছুই দেখা গেল না। ঝড় থামার পর সব লাপাত্তা। পাঠানো দুটি দলকে আর দেখা গেল না। এমনকি জাহাজটিও কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে। চারদিক তোলপাড় পড়ে গেল। চলল অনেক খোঁজাখুঁজি। কিন্তু কোথাও এর কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল না। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যের বেড়াজালে এমন আরও অনেক ঘটনা অমীমাংসিত হয়ে আছে। ‘এলেন অস্টিন’ জাহাজটির মতো আরও অসংখ্য অন্তর্ধানের গল্প বারমুডা ট্রায়াঙ্গলকে পৃথিবীর সেরা রহস্যাবৃত অঞ্চলে পরিণত করেছে। কিছু বাস্তববাদী মনে করেন এসব অন্তর্ধানের কারণ নিছক দুর্ঘটনা, যার কারণ হতে পারে প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা চালকের অসাবধানতা। আবার জনশ্রুতি আছে এসবের পেছনে দায়ী অতি-প্রাকৃতিক কোন শক্তি বা ভিনগ্রহের প্রাণীর উপস্থিতি। জায়গাটির রহস্যময়তা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে, বানানো হয়েছে অসংখ্য ডকুমেন্টারি। আরও কিছু রহস্যের ঘটনা উল্লেখ করা হল। ১৯৪১ সালের কথা । বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গেল তিনটি ট্যাঙ্কার, একটি চার ইঞ্জিনের উড়োজাহাজ আর একটি মৎস্য শিকারী ট্রলার। আরেকটি ঘটনা হল নাসাউ থেকে বাহামার গ্রান্ডটার্ক দ্বীপে যাচ্ছিল একটি হালকা বিমান। ওই দ্বীপের কাছাকাছি এসে পাইলট বেতার সংকেত জানালেন, “আমি কোন পথ খুঁজে পাচ্ছি না। দুটি অজানা দ্বীপের চারপাশে চক্কর মারছি। এই ধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসার কোন উপায় আছে কি?” এই দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষ কিছু সাক্ষী কিছু দ্বীপবাসী দেখল বিমানটি আধাঘন্টা ধরে উড়তে উড়তে কোন এক অজানায় অদৃশ্য হয়ে গেল। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের সবচেয়ে আলোচিত দুর্ঘটনা হল ৫টি টর্পেডো বম্বারের দুর্ঘটনা। ১৯৪৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ওই ত্রিভুজ স্থানে যানগুলো রহস্যজনকভাবে অদৃশ্য হয়ে যায়। ‘মেরী সিলেক্ট’ নামক জাহাজটির অন্তর্ধান কাহিনী অদ্ভুত। সেদিন আকাশে বিমান মহড়া চলছিল। প্রতিটি পাইলটকে নিয়ে মোট ৩ জন ক্রু থাকে। সেদিন ছিল ২ জন। দিনটি ৫ ডিসেম্বর। ফ্লাইট-৯০ বিমান আকাশে উড়ছে। আবহাওয়া খুবই পরিষ্কার ও মনোরম। হঠাৎ কন্ট্রোল টাওয়ারে বিশেষ জরুরি ও ভীত কণ্ঠস্বর- “মনে হচ্ছে আমরা পথভ্রষ্ট হয়েছি। আমরা মাটি দেখতে পারছি না”। টাওয়ার জিজ্ঞেস করল তোমাদের পজিশন জানাও। উত্তর এলো “আমরা কিছুই বলতে পারছি না। মনে হচ্ছে আমরা হারিয়ে গেছি”। বিকাল গড়িয়ে গেল। তখনও বিমানটি যেই তিমিরে উড়ছিল সেই তিমিরেই। তাদের উদ্ধারের জন্য ১৩ জন ক্রু নিয়ে একটি বিরাট মার্টিন মেরিনার ফ্লায়িং বোট “মেরী সিলেক্ট” পাঠানো হল। ফ্লাইং বোটটি অশান্ত সমুদ্রেও নামতে পারে এবং এমনভাবে তৈরি যে পানিতেও ডোবে না। ফ্লাইট-৯০-এর উদ্দেশ্যে কন্ট্রোল টাওয়ার বার্তা প্রেরণ করল- “যেখানে আছ সেখানেই থাক। সাহায্য প্রেরণ করা হল”। কিন্তু ঘটল আরও ভয়ঙ্কর কিছু। মেরিনার ফ্লাইং বোটটি শুধু জানাতে পেরেছিল যে, তারা সেই জায়গায় পৌঁছেছে। তবে ফ্লাইট-৯০কে দেখছে না। ব্যাস এটুকুর পর মেরিনাও উধাও! কন্ট্রোলরুমের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। কিছুই বোঝা গেল না। নেভার বোর্ড অব ইনকুয়েরি বৈঠক বসল। তদন্ত হল। আরও কিছু বিমান পাঠালো। তারা ভালোভাবে ফিরলেও ফ্লাইট-৯০ ও এত বড় মেরিনার বোট ‘মেরী সিলেক্ট’-এর একটি টুকরারও সন্ধান আনতে পারল না। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের আরেকটি বিখ্যাত ঘটনা হল ১৯৬২ সালের এপ্রিল মাসে অন্তর্ধান হওয়া ফ্লাইট-১৯। আমেরিকার ম্যাগাজিন লিজান দুর্ঘটনার বর্ণনা প্রকাশ করে এভাবে- পাইলট বলছিলেন, “আমরা কোথায় আছি জানি না, সবুজ রঙের পানি, কোথাও সাদা কিছু নেই”। ম্যাগাজিনটি প্রকাশের দিনই গোটা আমেরিকায় বারমুডা ট্রায়াঙ্গলকে নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। অতিপ্রাকৃত, শয়তানের জায়গা ইত্যাদি বিশেষণ যুক্ত হতে থাকে। অবশ্য বারমুডা ট্রায়াঙ্গলকে ১৪৯২ সালেই আমেরিকার আবিষ্কারক ক্রিস্টোফার কলম্বাস অতিপ্রাকৃত ও ভয়ংকর হিসেবে আখ্যায়িত করে গিয়েছেন। তিনিই সর্বপ্রথম এ অঞ্চল দিয়ে জাহাজ নিয়ে যাওয়ার সময়ের অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা লেখেন। তিনি লিখেছেন যে, এ অঞ্চল দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি ও তার নাবিকেরা দিগন্তে আলোর নাচানাচি ও আকাশে অনেক ধোঁয়া দেখেছিলেন। এছাড়া এ অঞ্চলে কম্পাসের উল্টাপাল্টা দিকনির্দেশনার কথাও তিনি উল্লেখ করেন। ১১ অক্টোবর, ১৪৯২ সালে লিখিত তার লগবুক হতে এসব তথ্য উদ্ধার হয়। ১৯৫০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ইভিডভিল্উ জোন্স নামের রিপোর্টার একটি খবরের কাগজে এসব কথা প্রকাশ করেন। ঠিক তার দুই বছর পর ‘ফেইট’ নামক ম্যাগাজিনে জর্জ ছোট্ট একটি প্রবন্ধ লেখেন। যেখানে ফ্লাইট-১৯-এর অন্তর্ধানের পর বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যের কথা ফোটে ওঠে। সাংবাদিক ভিনসেন্ট গডিস ১৯৬২ সালে লিজান ম্যাগাজিনে এবং এরপর ১৯৬৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে “প্রাণঘাতী বারমুডা ট্রায়াঙ্গল” নামক আরেকটি আরটিক্যাল লেখেন। পরে তিনি আরও বিস্তরভাবে অদৃশ্য দিগন্ত নামে বই লেখেন। বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে আরও লেখা রয়েছে জন ওয়েল্সের বিস্মৃত অন্তর্ধান, চার্লস্ বার্লিটজ, রিচার্ড উইনারের শয়তানের ত্রিভুজ ইত্যাদি। এসব বই ও ম্যাগাজিনে লেখকরা বারমুডা ট্রায়াঙ্গলকে রহস্যময়, অতিপ্রাকৃত, ভয়ংকর মৃত্যু-অঞ্চল হিসেবেই উপস্থাপন করেছেন। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যময় সব অন্তর্ধানের কারণ নিয়ে এসব বইয়ে নানা তত্ত্ব দাঁড় করানো হয়েছে। কেউ বলেছেন, ওখানকার আকাশ ও সমুদ্রের মাঝে এক বিশাল ফাটল রয়েছে। সেই প্রাকৃতিক ফাটলে পড়ে বিমান বা জাহাজ হারিয়ে যায় চিরতরে। কেউ বলেন, অজানা এক সভ্যতার কথা, যেখানে আগুনের গোলা সমুদ্র হতে আকাশ অবধি লাফিয়ে ওঠে, যা বিস্ফোরিত করে দেয় সব জাহাজ ও উড়োজাহাজ। কারও মতে, ওই অঞ্চলের পানি জাহাজকে পৃথিবীর গহবরে টেনে নেয়। কেউবা অতিরঞ্জিত করে বলেছেন, এসব ভিনগ্রহ প্রাণীর কান্ড, যারা বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে আস্তানা গেড়েছে। কেউ আবার বৈজ্ঞানিকভাবে ফোর্থ ডাইমেনশন বা ৪র্থ মাত্রার কথা বলেন, যা ওই অঞ্চলে বিদ্যমান। তাদের মতে সময়ের একটা অনন্ত ফাটল রয়েছে সেখানে। জাহাজ ও বিমানগুলো সেই সময়ের ফাটলে পড়ে হারিয়ে যায় বর্তমান থেকে হয়তো দূর ভবিষ্যতের গর্ভে বা অতীতের কোন ইতিহাসে। আবার অনেক বইতে লেখা রয়েছে, এতে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র, যা জাহাজকে ও উড়োজাহাজকে আকর্ষিত করে টেনে নিয়ে যায়। কারও বর্ণনায় পাওয়া যায় হয়তো বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যময় স্থানে প্রকৃতি সবসময় এমন কিছু রাসায়নিক যৌগ তৈরি করে, যা মানুষের যাবতীয় ইচ্ছা, বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি নষ্ট করে দেয় অথবা ইন্দ্রিয় অনুভূতিকে অবশ করে দেয়। ফলে সেখানে পাইলট বা নাবিক সবাই বোকা বনে যান আর চলে যান গহীন সমুদ্রের অতলে। বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে এসব যুক্তি বিশ্বাসযোগ্য হোক বা না হোক একথা সত্যি যে, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া সব অন্তর্ধানিত জাহাজ ও বিমানের রহস্যজট কখনও খোলেনি। তেমনি আজও রহস্য খোলেনি ওই অঞ্চল হতে প্রাপ্ত প্রাণীর অঙ্গবিশেষ ‘বারমুডা ব¬প’-এর। টেডি টাকার নামের এক দুঃসাহসিক ডুবুরী বারমুডার বেলাভূমিতে অদ্ভুত জৈবপিন্ড পান যার ওজন ১৫০০ পাউন্ডের বেশি। গবেষণার পর জানা যায়, পিন্ডটি অবশ্যই কোন প্রাণীর কোলেজন টিউমার। তারা এর নাম দেন ‘বারমুডা ব¬প’। অনেকে একে তিমি বা অক্টোপাসের দেহাংশ বললেও আজও সঠিকভাবে জানা যায়নি যে, এটি কোন প্রাণীর দেহাংশ। আরও আশ্চর্যের কথা হল পিন্ডটি বেলাভূমিতে পড়ে থাকতে থাকতে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলেও এতে এতটুকুও পচন ধরেনি। এইরকম হাজার ঘটনার সাক্ষ্য নিবরে বহন করে চলেছে এই রহস্যময় এলাকাটা, কেও খোঁজে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, কেও আবার অতিপ্রাকৃত ব্যাখ্যা খুঁজতে থাকে বেস্ত। এখনও পর্যন্ত বের করা যায়নি কোন সন্তোষজনক উত্তর। তাই, অমীমাংসিত রহস্য হিসেবে হয়ে আসছে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল।
Posted on: Wed, 22 Jan 2014 04:51:27 +0000

Trending Topics



Recently Viewed Topics




© 2015