মুক্তিসংগ্রামে ছাত্র - TopicsExpress



          

মুক্তিসংগ্রামে ছাত্র ইউনিয়ন (লেখাটি ছাত্র ইউনিয়নের ৬০তমপ্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সেমিনারে পঠিত, পরবর্তীতে একটি বুকলেট আকারে বের হয়। দীর্ঘ লেখাটির অংশবিশেষ প্রাসংগিক ও প্রয়োজনীয় বিধায় পোস্ট করলাম) স্বাধীনতার দাবি ও সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতিতে ছাত্র ইউনিয়ন একাত্তরের শুরুতেই ছাত্র ইউনিয়ন বুঝতে পারে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নেবার সময় ঘনিয়ে এসেছে। ঘোষণাপত্রে স্বাধীনতার দাবি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ’৭১-র ১৪ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের একটি বিশেষ জরুরি কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করা হয়।জরুরি কাউন্সিল শাসনতন্ত্র সম্পর্কে ১৪ দফা দাবি প্রণয়ন করে। এতে বলা হয় ‌পাকিস্তানের যে মূল পাঁচটি ভাষাভাষী জাতির অবস্থান, উহাদের সকলকে পাকিস্তান ফেডারেশন থেকে বিচ্ছিন্ন হইয়া স্বতন্ত্র স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের অধিকারসহ পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রাণাধিকার দিতে হইবে।’ আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে অনেক গোপন সংগঠন, কিংবা প্রকাশ্য সংগঠন গোপনে স্বাধীনতার দাবি অনেক আগে থেকেই তুলেছেন, কিন্তু একটি প্রকাশ্য সংগঠনের অফিসিয়াল দলিলে স্বাধীনতার দাবি সম্ভবত এটাই প্রথম ঘটনা। ১৯৭১ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে ব্রাতিশ্লাভা শহরে আন্তর্জাতিক ছাত্র ইউনিয়নের (আইইউএস) দশম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্বের শতাধিক দেশের ছাত্র প্রতিনিধির উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এই কংগ্রেসে ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জনগণের ন্যায্য দাবি ও সংগ্রামের কথা তুলে ধরা হয়। কংগ্রেসে বাংলাদেশের জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবি ও সংগ্রামের সমর্থনে এক প্রস্তাব গৃহীত হয়। ছাত্র ইউনিয়ন এই কংগ্রেসে আইইউএস-এর কার্যকরী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়। ফলে পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সকল দেশের ছাত্র-যুব সমাজের সমর্থন ও সাহায্য লাভ সহজ হয়। সংগ্রামের ধারাবাহিকতায়, ২২ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত ছাত্র ইউনিয়নের সমাবেশে ঘোষণা করা হয়, ‘তেসরা মার্চ সংসদ না বসলে বাংলাদেশ স্বাধীন হবে।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে কোন সংগঠনের পক্ষ থেকে এটাই প্রথম ঘোষণা বলে বিবেচিত হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র ইউনিয়ন আয়োজিত এক সমাবেশের প্রস্তাবে বলা হয়, ‘পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের সভা অবশ্যই বসতে হবে এবং গণতান্ত্রিক নিয়ম মতো কোরাম হলেই তাকে আইনসিদ্ধ বলে ঘোষণা করতে হবে। অন্যথায় সংকটজনক পরিস্থিতির জন্য গণতন্ত্রবিরোধী পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীই দায়ী থাকবে।’ সমাবেশে আরো বলা হয়, ‘জনগণের ভোটের রায় বাস্তবায়নের পথে কোনো প্রকার ষড়যন্ত্রই এদেশের ছাত্রসমাজ বরদাস্ত করবে না।’ ১৯৭১ সালের ১ মার্চ সংসদের অধিবেশন বাতিল করা হলে, দেশের মানুষ স্বত:স্ফুর্তভাবে রাস্তায় নেমে পড়ে। বায়তুল মোকাররম মসজিদের কাছে ছাত্র ইউনিয়নের একটি বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ শেষে মিছিল নিয়ে নেতা-কর্মীরা শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। গুলিস্তান কামানের ওপর দাঁড়িয়ে এক স্বতঃস্ফ‚র্ত সমাবেশে ছাত্র ইউনিয়ন নেতারা বলেন, ‘বাঙালি গণতন্ত্র চেয়েছিল কিন্তু পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী তা দেয়নি, বাঙালিরা এবার তাদের দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবে।’ ওই দিন হোটেল পূর্বাণীতে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে গঠিত পূর্বের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদকে সক্রিয় করার প্রস্তাব দেয় ছাত্র ইউনিয়ন। কিন্তু সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে ছাত্রলীগ এ প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। ২ মার্চ ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র লীগ, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র (টিইউসি), জাতীয় শ্রমিক লীগ, কৃষক সমিতি প্রভৃতি সংগঠনের ডাকে কোন প্রচারণা ছাড়াই সফল হরতাল পালিত হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়ন সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন করে। পল্টন ময়দানে ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ উদ্যোগে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ যুক্তফ্রণ্ট গঠন করে পাড়া-মহল্লায় সংগ্রাম কমিটি গঠনের কথা বলেন। সা¤্রাজ্যবাদ ও শোষকগোষ্ঠী সম্পর্কেও সচেতন থাকার ও তাদের বিরুদ্ধেও সংগ্রাম পরিচালনার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘অন্যথায় শোষণ বন্ধ হবে না। আবার ঠকিতে হইবে।’ ৪ তারিখে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছাত্র ইউনিয়নের সমাবেশ থেকে ইয়াহিয়া প্রস্তাবিত নেতৃসম্মেলন প্রত্যাখ্যান করে বলা হয়, এ ধরণের সম্মেলন হতে দেয়া হবে না। এ সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মকান্ড পরিচালিত হতে থাকে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, সাইন্স এ্যানেক্স ভবনের ক্যান্টিন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠ পরিণত হয় ছাত্র ইউনিয়নের কাজের কেন্দ্রে। ছাত্রসমাজকে সংগঠিত করে মুক্তিসংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করে তুলতে থাকে ছাত্র ইউনিয়ন। মার্চের প্রথম দিন থেকেই, প্রতিদিন বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ছাত্র-গণ সমাবেশের আয়োজন করে চলমান ঘটনাবলী ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জনগণকে ব্রিফিং করা হতো। পল্টন ময়দানে বড় জনসভা করেও জনগণের কাছে প্রয়োজনীয় বার্তা তুলে দেয়া হতে থাকে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পরে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি কাজ আরো জোরদার করা হয়। শোষণমুক্ত স্বাধীন পূর্ব বাংলা কায়েমের জন্য সম্ভাব্য দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণ করে ছাত্র ইউনিয়ন। সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলার চিন্তা থেকে ছাত্র ইউনিয়ন সংগঠনের কর্মী ও সচেতন ছাত্র-ছাত্রীদেরকে তালিকাভুক্ত করা শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে প্রতিদিন সকাল থেকে ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীরা শুরু করেন কুচকাওয়াজ, সামরিক প্রশিক্ষণ। ডামি রাইফেল দিয়ে অস্ত্র চালনার পদ্ধতি শেখানো হয়। সংগঠনের নারী কর্মীরাও এ প্রশিক্ষণে অংশ নেন। প্রয়াত বিপ্লবী ও শহীদদের নামে আলাদা আলাদা ব্রিগেড গঠন করা হয়। এসব ব্রিগেডকে রাজনৈতিক দায়িত্ব দেয়ার পাশাপাশি সামরিক কুচকাওয়াজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতে থাকে। ২৫ মার্চ পর্যন্ত এ প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়। জেলায় জেলায়ও একই কায়দায় ট্রেনিং শুরু হয়ে যায়। এছাড়া ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে ডামি রাইফেল নিয়ে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি, সত্যিকারের বন্দুক চালনার প্রশিক্ষণও শুরু হয়। ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে ‘বোমা স্কোয়াড’ গঠন করা হয়। ল্যাবরেটরী থেকে কেমিক্যাল চুরি করে এনে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা বিস্ফোরক তৈরির কাজ শুরু করেন। প্রতিদিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মাইক থেকে ‘ককটেল’ তৈরি ও ব্যবহারের ওপর গণপ্রশিক্ষণ পরিচালনা করা হতে থাকে। ইয়াহিয়া শাহীর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার প্রস্তুতি হিসেবে ছাত্র ইউনিয়ন পাড়ায় পাড়ায় গণকমিটি গঠনের আহŸান জানায় এবং গণকমিটি গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। জনগণকে সংগ্রামে উদ্দীপ্ত করার জন্য ১২ মার্চ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পথসভা ও পথসভা শেষে মিছিল বের করা হয়। ১৩ মার্চ বায়তুল মোকাররম মসজিদের গেট থেকে মশাল মিছিল বের করা হয়। ১৪ মার্চ বায়তুল মোকাররম মসজিদের গেটে অনুষ্ঠিত জনসভায় মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সকলকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘শাসকগোষ্ঠী তার মরণ কামড় দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে।’ এই সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে জেলা, থানা, প্রাথমিক শাখাসমূহকে সর্বাত্মক রাজনৈতিক প্রচার চালানো, জনগণের মধ্যে সংগ্রাম কমিটি ও গণবাহিনী গঠন করা, গ্রামে কৃষকদের মধ্যে আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়া, বৃহত্তর দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের জন্য ‘যার যা আছে তাই নিয়ে’ প্রস্তুতি গ্রহণ করা, জঙ্গী কর্মী বাহিনীর সমন্বয়ে নিয়মিত প্যারেড অনুষ্ঠান করার নির্দেশ দেয়া হয়।১৬ মার্চ ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিবের মধ্যকার বৈঠকের প্রেক্ষিতে ছাত্র ইউনিয়ন কমরেড মণি সিংহসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি ও সামরিক আইনে দায়েরকৃত সকল রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানায়।১৯ মার্চ ছাত্র ইউনিয়ন শোষণমুক্ত স্বাধীন বাংলা কায়েমের সংগ্রাম দুর্বার করে তোলার জন্য একটি প্রচারপত্র বিলি করে। এতে বলা হয়, ‘...আমরা জনগণের এই মহান বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামকে সঠিক নীতিতে অগ্রসর করিয়া লইয়া এমন একটি ‘স্বাধীন পূর্ব বাংলা’ রাষ্ট্র গঠনের আহ্বান জানাইতেছি, যে রাষ্ট্রে শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-মধ্যবিত্ত-বুদ্ধিজীবী প্রভৃতি জনগণের প্রকৃত আশা-আকাংক্ষা পূরণের পথ উন্মুক্ত হইবে।’ ‘...তথাকথিত দেশপ্রেমিকরা এই সংগ্রামকে ভুল পথে ঠেলিয়া দেওয়ারও প্রচেষ্টা করিতেছে। ইহারা স্বাধীন পূর্ব বাংলায় তাহাদের শ্রেণীস্বার্থ হাসিলের লক্ষ্য হইতে বাঙালি জনতাকে বুঝাইতে চায় যে, এই সংগ্রামে পূর্ব বাংলার অবাঙালি মেহনতী জনগণও আমাদের দুশমন। প্রকৃতপক্ষে যে শাসকগোষ্ঠী আমাদের সংগ্রামকে দমন করিতে চাহিতেছে, ইহারা পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণকেও শোষণ করিতেছে। তাই এই সংগ্রাম পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে নয়, পূর্ব বাংলার অবাঙালিদের বিরুদ্ধেও নয়। এই সংগ্রাম পরিচালিত করিতে হইবে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী ও ইহাদের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে।’ ২০ মার্চ ঢাকায় অবিস্মরণীয় একটি ঘটনা ঘটে। ছাত্র ইউনিয়নের ট্রেনিংপ্রাপ্ত গণবাহিনীর শত শত সদস্য রাজপথে ডামি রাইফেল কাঁধে নিয়ে মার্চ করে। এ দৃশ্য ছিল ঢাকার মানুষের কাছে নতুন। জনতা উদ্বেলিত হয়ে ওঠে এবং করতালির মাধ্যমে অভিনন্দন জানায়। এই ঘটনা সমগ্র শহরে এক বিরাট সাড়া জাগায়। এ সময় ১২টি প্লাটুনে বিভক্ত হয়ে গণবাহিনীর সদস্যরা প্যারেড, শরীরচর্চা ও রাইফেল কলাকৌশল প্রদর্শন করে। প্রিয় মাতৃভ‚মি পূর্ব বাংলাকে প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী বিশেষ করে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাাদ ও একচেটিয়া পুঁজির শোষণ থেকে মুক্ত করে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শ্রমিক-কৃষক জনতার মুক্তির পথ উন্মুক্ত করার শপথ গ্রহণ করা হয়। ২৫ মার্চ ভোর বেলা সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ও তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ রাতের সম্ভাব্য আক্রমণ সম্পর্কে সতর্ক করে একটি ‘চিরকুট’ ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃত্বের কাছে পাঠান। ‘চিরকুট’ পেয়ে ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কতগুলো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়। জনগণকে সজাগ করার জন্য ঢাকা শহরের সর্বত্র ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীরা ছড়িয়ে পড়েন। মাইকযোগে সতর্ক-বার্তা প্রচার করা হয়। ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীরা পথসভা ও খন্ডমিছিল নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। শহীদ মিনারের সমাবেশে জনগণকে সতর্ক থাকতে এবং প্রতিরোধের ব্যুহ রচনা করতে আহবান জানানো হয়। হলে, হোস্টেলে না থাকার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদেরকে সতর্ক করে দেয়া হয়। ২৫ মার্চের কালো রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আজিম, সুশীলসহ কয়েকজন ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও, সকল ছাত্রকে হল থেকে সরাতে না পেরে হলেই থেকে যান এবং লক্ষ লক্ষ শহীদের সাথে নিজেদের একাত্ম করে দেন। সাধারণ ছাত্রদের সুখ-দুঃখে সাথে থাকতে হবে- এই চেতনাবোধই এদেরকে হল থেকে সরে গিয়ে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ আস্তানায় যেতে দেয়নি। এভাবেই ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিরোধের পথে অগ্রসর হয়, সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার দৃপ্ত শপথে সশস্ত্র যুদ্ধে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী জনতার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে। যুদ্ধের ময়দানে ছাত্র ইউনিয়ন ২৫ মার্চের কালো রাতের পর ছাত্র ইউনিয়ন যুদ্ধ পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় অংশ নেয়। ছাত্র ইউনিয়ন,জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনে ছাত্র লীগকে সাথে নিয়ে একটি যৌথ গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ছাত্র লীগ এ প্রস্তাবে সম্মতি দেয়নি। সেসময় ছাত্রলীগের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ছাত্র ইউনিয়নের ঐক্য প্রচেষ্টা সফল হয়নি। অনেক পওে এই ঐক্য প্রচেষ্টার এক পর্যায়ে নভেম্বর মাসে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ নেতৃত্বের একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হয়। যদিও ছাত্রলীগের একটা অংশ এই বিবৃতিরও বিরোধীতা করে। ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র লীগের যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়Ñ There is nothing in the world more glorious than sacrificing our lives in the struggle for liberating our motherland. ২৫ মার্চের পর যখন হাজার হাজার মানুষ দেশ ছেড়ে সন্ত্রস্ত্রভাবে পালিয়ে যাচ্ছে, তখন ছাত্র ইউনিয়নের নির্ভীক কর্মীরা মৃত্যুর ভয় উপেক্ষা করে দেশপ্রেমের মহান কর্তব্যের প্রতি নিষ্ঠাবান থেকেছেন। ছাত্র ইউনিয়ন দেশব্যাপী ছাত্র, তরুণ, যুবকদের সংগঠিত করে সর্বাত্মক সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে। প্রথম থেকেই ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা দেশের ভেতওে যেখানে যতটা সম্ভব সেই মত প্রতিরোধের চেষ্টায় নিয়োজি হয়। যেখানেই সম্ভব তারা সেখানেই পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী সদস্যদের সহায়তায় সক্রিয় ভ‚মিকা পালন করে। নরসিংদীর রায়পুরা, শিবপুর, চট্টগ্রাম, বগুড়া, পাবনা, বরগুনা, পিরোজপুর প্রভৃতি অঞ্চলে প্রাথমিক প্রতিরোধের অন্যতম শক্তি ছিল ছাত্র ইউনিয়ন সহ অন্যান্য বামপন্থীরা। আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য ছাত্র ইউনিয়ন বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে দিল্লীতে এক বিরাট প্রেস কনফারেন্স করে বিশ্বের সামনে সকল ঘটনাবলী তুলে ধরা হয়। ২০ মে সংগঠনের পক্ষ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন ছাত্র-যুব সংগঠনের কাছে চিঠি পাঠানো হয়। এতে বিশ্বের সকল ছাত্র যুব সংগঠনের প্রতি স্বীকৃতি, অস্ত্র, অর্থ, খাদ্য, ওষুধ ইত্যাদি প্রদান করার আহ্বান জানানো হয়। এরই প্রেক্ষিতে ছাত্র ইউনিয়নের কাছে লিখিত চিঠিতে বিশ্ব গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন, আন্তর্জাতিক ছাত্র ইউনিয়ন (আই.ইউ.এস), সোভিয়েত যুব কমিটিসহ বিশ্বের বহু সংগঠন মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন ও সংহতি প্রকাশ করে। দুনিয়ার নানা প্রগতিশীল ছাত্র-যুব সংগঠন মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর পোস্টার ও প্রচারপত্র প্রকাশিত হতে থাকে। ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করা হলে, ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে নবগঠিত সরকারকে স্বাগত জানিয়ে এক ঐতিহাসিক বিবৃতি প্রচার করা হয়। বিবৃতিতে ছাত্র ও যুব সমাজকে সকল শক্তি নিয়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানানো হয়। এপ্রিল মাস থেকেই বাংলাদেশ থেকে ভারতে আগত ছাত্র-যুবকদের ট্রেনিং দেওয়া শুরু হয়। কিন্তু সেটা ছিল বিক্ষিপ্তভাবে। পরবর্তীতে মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ। এর আগ পর্যন্ত প্রশিক্ষণে ছাত্র ইউনিয়ন তথা বামপন্থী কর্মীদের অংশগ্রহণ সহজ ছিলো না। মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুটিং ও প্রশিক্ষণের জন্যে সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে যুব শিবির ও অভ্যর্থনা শিবির স্থাপন করা হয়। এ সবের বোর্ড অব কন্ট্রোল ছিলেন খন্দকার মোশতাকের ঘনিষ্ঠ অনুচর মাহবুব আলী চাষী। এই সব শিবিরে বামপন্থী ছাত্র যুবকদের প্রশিক্ষণের সুযোগ যেন না ঘটে, সে লক্ষে ‘স্ক্রীনিং’-এর সময় বামপন্থী ছাত্র-তরুণরা ‘বহির্দেশীয় আনুগত্য’ থেকে মুক্ত নয় বলে তুলে ধরা হয়। এর প্রধান শিকার হয় ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা। আওয়ামী পরিষদ দ্বারা শনাক্তকৃত হওয়ার পরই কেবল এইসব শিবিরে যুক্ত হওয়ার সুযোগ ঘটতো। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের একটা অংশ বামপন্থী কর্মীদের সশস্ত্র ট্রেনিং নেয়ার ক্ষেত্রে আপত্তি তোলে এবং বাধা দেয়। এতদ¯^ত্তে¡ও অসংখ্য ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী তাদেও সাংগঠনিক পরিচয় গোপন রেখে বিভিন্ন সেক্টরের এফএফ বাহিনী ও মুক্তি বাহিনীতে ঢুকতে সক্ষম হয়। তারা অসীম সাহস ও বীরত্ব দেখিয়ে তাদেও অমোঘ দেশপ্রেমের প্রমাণ রাখে ও শ্রেষ্ঠ যোদ্ধার মর্যাদা লাভ করে। এক পর্যায়ে যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদী হয়ে পড়লে বামপন্থীদের মোকাবেলার উদ্দেশ্যে ‘মুজিব বাহিনী’ গঠন করা হয়। তারা তাজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বেরও বিরোধীতা করতে থাকে। অস্থায়ী সরকার ‘মুজিব বাহিনী’কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না। উল্টো ‘মুজিব বাহিনী’ অস্থায়ী সরকারের বিপরীতে স্বতন্ত্র নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায়। ভারতের শাসকগোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়াশীল অংশের সাথে তাদের যোগাযোগ ছিল। ঐক্যবদ্ধ মুক্তিসংগ্রামের প্রশ্নে ‘মুজিব বাহিনী’ বাতিল করা প্রয়োজন হয়ে পড়লেও, সেটা করা সম্ভব হয়নি। ছাত্র ইউনিয়নের জন্যও স্ব-উদ্যোগে যুদ্ধ পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় অংশ নেয়ার সুযোগ তৈরী হয়। তার ফলশ্রæতিতে মে মাসেই ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনী গঠিত হয়। ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃত্ব তাজউদ্দিন আহমদ ও প্রধান সেনাপতি ওসমানীর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। এক পর্যায়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ডি. পি ধরের সাথেও ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দের বৈঠক হয়। তাজউদ্দিন আহমদের রাজনৈতিক উপদেষ্টা মঈদুল হাসান এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ডি. পি ধর এবং তাজউদ্দিন আহমদ প্রশিণে বামপন্থীদের যুক্ত করার ক্ষেত্রে আগ্রহী ছিলেন এবং তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অবস্থার পরিবর্তন ঘটে ভারতের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই)’র হস্তক্ষেপে। মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ইন্দিরা গান্ধী ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের ট্রেনিং এর ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দেন। বামপন্থীদের মোকাবেলায় গঠিত ‘মুজিব বাহিনী’ প্রথম থেকেই তাজউদ্দিন আহমদের বিরোধীতায় সোচ্চার ছিল। তাজউদ্দিন আহমেদও বামপন্থী যুবকদের ট্রেনিং দিতে বিশেষ ভ‚মিকা পালন করেন। ‘মুজিব বাহিনী’কে বাতিল করা সম্ভব না হলেও, বামপন্থী যুবকদের ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করার মধ্য দিয়ে একটা ভারসাম্যমূলক অবস্থা তৈরি করা সম্ভব হয়।এ প্রসঙ্গে ডি.পি ধরের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য : Objection to recruit left elements was lifted mainly to offset the influence of Mojib Bahini. . ’ (মঈদুল হাসান, মূলধারা ’৭১) বামপন্থীরা ট্রেনিং লাভে সমর্থ হওয়ায়, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম’-এর ধারায় অগ্রসর করা সহজতর হয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সমর্থন লাভের বিষয়টি নিশ্চিত হয়। আসামের তেজপুরের নিকটবর্তী সালোনবাড়ি নামক স্থানে একটি বিশেষ ক্যাম্প স্থাপন করে মে মাসের ২৮ তারিখে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি- ছাত্র ইউনিয়নের ‘বিশেষ গেরিলা বাহিনী’র প্রথম ব্যাচের ২০০ জনের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকও সেই দলে ছিলেন। চার সপ্তাহ পরে এদের মধ্যে ৫০ জনকে বিশেষ ট্রেনিং-এর জন্য নেফা এলাকার ভালুকপং-এর একটি দুর্গম এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। ১১ জুলাই শেষ হয় প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণে ছাত্র ইউনিয়নসহ বামপন্থীদের উচ্চমান দেখে পরবর্তী ব্যাচগুলোতে গেরিলার সংখ্যা ডবল করে ৪০০ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। পর্যায়ক্রমে ব্যাচের পর ব্যাচ প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। ট্রেনিং শেষে বিশেষ গেরিলা বাহিনী ত্রিপুরার একটি নির্জন স্থানে তাদের বেইসক্যাম্প স্থাপন করে। এখান থেকেই অপারেশন প্লানিং কমিটির পরিচালনায় দেশের ভেতর গেরিলাদের ‘ইনডাকশনে’র কার্যক্রম ও গেরিলা অপারেশনসহ সামরিক তৎপরতা চালানো হয়। অস্ত্রপাতির পর্যাপ্ত সরবরাহ ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা সম্পন্ন হবার পর সেপ্টেম্বরের শুরুতে ইনডাকশন শুরু হয়। প্রথম ব্যাচের গেরিলাদের ইনডাকশন শেষ হবার পর পরবর্তী ব্যাচের যোদ্ধারা একে একে দেশের ভেতরে ঢুকে অবস্থান নিতে থাকে। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ছোট ছোট অপারেশন শুরু হয়ে যায়। অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে অপারেশনের সংখ্যা বাড়তে থাকে। নভেম্বরের মাঝামাঝি পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না। এই অবস্থায় অপারেশনের মাত্রা বৃদ্ধি করার জন্য দেশের অভ্যন্তরেরর বিভিন্ন গ্রæপকে নির্দেশ দেয়া হয়। সেই অনুযায়ী বাড়ে অ্যাকশনের সংখ্যা। রায়পুরা, মনোহরদী, শিবপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, বৃহত্তর বরিশাল প্রভৃতি এলাকায় একের পর এক সফল অ্যাকশন পরিচালিত হয়। গেরিলা বাহিনীর অ্যাকশনগুলোতে ছাত্র ইউনিয়নের যোদ্ধারা পালন করেন বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা। একাত্তরের ১১ নভেম্বর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সুমহান গৌরবগাঁথায় যুক্ত হয়েছিল একটি উজ্জ্বল রত্নকণিকা। সেদিন কুমিল্লার সীমান্তবর্তী বেতিয়ারায় পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে গেরিলা বাহিনীর তুমুল যুদ্ধ হয়। কয়েক ঘন্টা ধরে চলা অনেকটাই ‘হ্যান্ড টু হ্যান্ড’ যুদ্ধে শহীন হন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা নিজামউদ্দিন আজাদ, সিরাজুল মুনিরসহ ৯ জন গেরিলা যোদ্ধা। সেদিন শত্রুবাহিনীর অকস্মাৎ অ্যামবুশ এবং আক্রমণের মুখেও ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনী যে সাহসের পরিচয় দিয়ে যুদ্ধ করেছেন, তা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যোগ করেছে আরেকটি অনুপ্রেরণাদায়ী অধ্যায়। এখনো প্রতিবছর ১১ নভেম্বর ছাত্র ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, খেলাঘর প্রভৃতি সংগঠন এবং এলাকাবাসী সেই গেরিলা যোদ্ধাদের সমাধিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করে এবং সেই বীর যোদ্ধাদের স্মৃতিচারণ করে। ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল অপারেশন প্লানিং কমিটি। পূর্বাঞ্চলীয় জোন এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় জোন- এই দুই কেন্দ্র ধরে সমস্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছিল। নভেম্বরের শেষ দিকে যখন বোঝা যায় যে সহসাই চূড়ান্ত পর্যায়ের কনভেনশনাল যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে, তখন সব গেরিলা ইউনিটকে নির্দেশ দেয়া হয় যে, পাকিস্তানী সেনারা যাতে ক্যাম্পের বাইরে মুভমেন্ট না করতে পারে, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে। গেরিলা কায়দা অনুসরণের পরিবর্তে তাদের কনভেনশনাল যুদ্ধের কলাকৌশল অবলম্বন করার পরামর্শ দেয়া হয়। আরো পরে যখন সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়, সব ইউনিটকে তখন যতো দ্রুত সম্ভব ঢাকার কাছাকাছি পৌঁছে ঢাকাকে ঘেরাও করতে বলা হয়। ট্রেণিংপ্রাপ্ত যে কয়েকশ গেরিলার তখনো ইনডাকশন হয় নি, তাদেও সবাইকে একসাথে নিয়ে অতি দ্রুত মার্চ করে ঢাকাকে চারদিক থেকে ঘেরাও করে রাখার উদ্যোগ নিতে বলা হয়। একটি বড় গেরিলা দল ঢাকার দক্ষিণাঞ্চলে সাময়িক ঘাঁটি স্থাপণ করে। ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যে বিশেষ গেরিলা বাহিনীর শত শত যোদ্ধা দোহার, নবাবগঞ্জ, শ্রীনগর, গজারিয়া ইত্যাদি এলাকায় জমায়েত হয়ে ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা চ‚ড়ান্ত করে। ১৪ ডিসেম্বর অস্ত্রসজ্জিত ও সমর সম্ভারসহ গেরিলা দলের ঢাকায় প্রবেশের অভিযান শুরু হয়। অব্যাহত চাপের মুখে পর্যুদস্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ভোর হতেই রাজধানীর উপকন্ঠে থাকা গেরিলা দল মার্চ করে সকালের মধ্যে চলে আসে ঢাকার কেন্দ্রস্থলে। বিধ্বস্ত শহীদ মিনারে রাইফেল উঁচিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যে দলটির শপথ নেবার ছবি দেশবিদেশে বহুল প্রচারিত, তা ছিল ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনীর দল, শত্রুমুক্ত ঢাকা শহরে যারা প্রথম প্রবেশ করেছিল। ছাত্র ইউনিয়নের বীর যোদ্ধারা সেদিন মুক্ত ঢাকায় ‘মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজ’ গড়ার শপথ নিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনের একটি রিপোর্টে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম উল্লেখ করেন, ‘২৫ মার্চ সশস্ত্র স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হলে জনগণ ও ছাত্র সমাজের বিভিন্ন অংশের পাশাপাশি আমাদের সংগঠনের সদস্য-সদস্যারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তি সংগ্রামে যোগ দেয়। প্রথম দিকে আমাদের বিপুল সংখ্যক কর্মী মুক্তিবাহিনীতে ট্রেনিং নেয় এবং পাক বাহিনীর মোকাবেলায় এগিয়ে যায়। আমরা প্রথম থেকেই ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি প্রভৃতি দলের সাথে ঐক্যবদ্ধ বাহিনী গড়ে তোলার চেষ্টা করি। কিন্তু এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি মিলিত ভাবে গেরিলা বাহিনী গড়ে তুলি। পরবর্তীতে আমরা সংগঠনের নিজস্ব নামেও বিশেষ গেরিলা বাহিনী ট্রেনিং ও গেরিলাযুদ্ধ সংগঠিত করি।’ রিপোর্টে আরো বলা হয়, ‘আমাদের ঐক্যের প্রচেষ্টা পুরপুরি সফল না হলেও জনগণের মধ্যে এবং বিভিন্ন মুক্তি সংগ্রামীদের মধ্যে ঐক্য বজায় ছিল। সহযোগী ছাত্রসংগঠনের কিছু কিছু সদস্য বিভেদাত্মক কার্যকলাপ চালায়। আমরা এর নিন্দা করি।’ গেরিলা বাহিনীতে ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা সম্পর্কে রিপোর্টে বলা বলা হয়, ‘আমাদের নিজস্ব গেরিলা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ছয় হাজার। এবং মুক্তিফৌজ ও গেরিলা বাহিনীতে আমাদের সংগঠনের মোট শক্তি ছিল প্রায় পনের হাজার।’ এখানে উল্লেখ্য যে, নানা প্রতিকূলতা স্বত্ত্বেও মুক্তিবাহিনী, এফ এফ বাহিনীতে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীসহ অসংখ্য বামপন্থী তরুণ যোগ দেয়। মেরিন গেরিলা বাহিনীর বিভিন্ন অপারেশনে বামপন্থীরা অসামান্য কৃতিত্ব দেখান। ঢাকার ঐতিহাসিক ক্র্যাক প্লাটুনের ঐতিহাসিক সাহসী অপারেশনগুলোতে বামপন্থী তরুণেরা তাদের সাহস, দেশপ্রেম, দক্ষতা, আত্মত্যাগের প্রমাণ রেখেছে। এছাড়াও, দেশের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা বিভিন্ন আঞ্চলিক বাহিনীতেও ছাত্র ইউনিয়নসহ বামপন্থী চিন্তার তরুণদের ভূমিকা ছিল অসামান্য।
Posted on: Sat, 27 Sep 2014 00:32:29 +0000

Trending Topics



Recently Viewed Topics




© 2015