সদ্য পাশ করে বের হওয়া অনেক জুনিয়র ডাক্তারদের মাঝেই দেখছি নিদারুণ হতাশা বিরাজ করছে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। কাজের পরিবেশ নিয়ে অনেকেই শঙ্কিত। ইনবক্সে দুই একজনের মেসেজ থেকে আভাস পেলাম পেশাজীবনে প্রবেশের পূর্বেই নিজেদের পেশা নিয়ে তাদের মনে অনিশ্চয়তার ছাপ। তোমাদের জন্যেই এই ঘটনাটা নতুন করে বলছি। পড়; উদ্বুদ্ধ হবে নিশ্চিত। আমার সাপ্তাহিক বাজার করার তারিখ ছিল সেদিন। আমাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডরমেটর...িতে পালা করে সাপ্তাহিক বাজার করার নিয়ম। সন্ধ্যাবেলা দু’হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে লোকজনের ভিড় ঠেলে কোনমতে হাঁটছি। হঠাৎ মোবাইল ফোন বেজে উঠল। রিসিভ করতে ও প্রান্ত থেকে নার্সের উদ্বিগ্ন গলা : স্যার! জলদি আসেন। একটা রোগী খুব সিরিয়াস! - ডাঃ তানিম কোথায়? উনি তো ডর্মেই, কাছাকাছি আছেন দ্রুত আসতে পারবেন। তাছাড়া আজকে উনারই ডিউটি। : তানিম স্যার নিজেই অসুস্থ। প্রেশার লো হয়ে গেছে নাকি। স্যার আপনি তাড়াতাড়ি আসেন, রোগী খুবই সিরিয়াস! লোকজনের ভিড় ঠেলে দু’হাতে ব্যাগ নিয়ে আমি প্রায় দৌড়ে গেলাম হাসপাতালে। যেয়ে দেখি নার্স এক বৃদ্ধ রোগীর বিছানার পাশে উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে, ইলেক্ট্রিসিটি নেই তাই তার হাতে একটা চার্জার লাইট। সেই রোগী চিৎকার করছে গলা ফাটিয়ে, হাত পা ছুড়ছে। দুজন লোক তাকে বিছানার সাথে চেপে ধরে আছে। বমি করে বিছানা ভাসিয়েছে, মেঝেতেও করুন অবস্থা। জানতে পারলাম সকালে ভর্তি হয়েছে এই রোগী পাতলা পায়খানা নিয়ে। তার সাথে একটু কথা বলার চেষ্টা করলাম। যতটুকু বলতে পারল তাতে জানলাম যে তার হাত পা নাকি ভেঙ্গে যাবার অবস্থা, মাথা ভনভন করছে। আমি পাল্স দেখার জন্যে হাত ধরতে গিয়ে চমকে উঠলাম, লোকটির যে একটি হাত কাঁধ থেকে কাটা তা আগে খেয়াল করিনি। অন্য হাতটি ধরলাম; খুবই ঠাণ্ডা হাত! পাল্স বলতে গেলে টেরই পাওয়া যায়না! প্রচণ্ড রকম পানি শূন্যতা আর ইলেক্ট্রোলাইট তারতম্যের ফল। হাত পা খিঁচুনি দিচ্ছে, যে কোন সময় হার্ট এ কোন দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। একটা কলেরা স্যালাইন চলছিল তাও খুব ধীর গতিতে। একসাথে অন্তত দুটি স্যালাইন চালানো প্রয়োজন। নার্সকে বললাম ক্যানুলা আনতে। সে বলে- : স্যার ক্যানুলা নাই। - নাই মানে? : স্যার, ক্যানুলা তো সাপ্লাই হয় না। পকেট থেকে স্লিপ প্যাড বের করে ‘ক্যানুলা’ লিখে বৃদ্ধের বিছানার পাশে দাঁড়ানো মহিলাকে বললাম দৌড় দিয়ে গেটের সামনের দোকান থেকে কিনে আনতে। মহিলা কাঁদতে কাঁদতে বলল যে তার কাছে কোন টাকা নাই। পকেট থেকে একশ টাকার একটা নোট বের করে তার হাতে দিলাম। পড়িমরি করে ছুটল সে দোকানের দিকে। ক্যানুলা আসল। নার্সের হাতে দিয়ে আমি তার হাত থেকে চার্জলাইট নিয়ে ধরলাম। লাইটের আলোতে নার্স মুহূর্তের মাঝে একটা হাত আর এক পায়ে দুইটা ক্যানুলা সেট করে ফেলল। আগে থেকেই রেডি করে রাখা দুটা স্যালাইন চালিয়ে দিলাম। একটা স্যালাইন ব্যাগের উপর প্রেশার মাপার যন্ত্র পেঁচিয়ে চাপ বাড়িয়ে দিলাম, আরেকটা ব্যাগ নিজেই হাত দিয়ে চাপতে থাকলাম। কলের মতো বেগে তরল যেতে লাগল রক্তে। পুরো প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ে দুজন লোক যারা অন্য রোগীর অ্যাটেনডেন্ট তারা রোগীটার হাত পা ধরে রেখেছিল। মিনিট পাঁচেক পর রোগীর হাত পা ছোঁড়াছুড়ি, চিৎকার চেঁচামেচি বন্ধ হতে থাকল ধীরে ধীরে। পরম করুণাময় সেদিন সেই পঙ্গু বৃদ্ধের উপর দয়ার পরশ বুলিয়ে দিয়েছিলেন, সেই দয়ার যৎসামান্য নিশ্চয়ই আমার জন্যেও রেখেছিলেন তুলে। বেঁচে গিয়েছিল রোগীটি। পরে জানতে পেরেছিলাম ভিক্ষা করে পেট চলে সেই বৃদ্ধের আর তাঁর স্ত্রীর। ছেলেমেয়েরা কেউ খোঁজ করেনা তাদের। এরপর বেশ অনেকদিন কেটে গেছে। প্রতিদিনের ব্যস্ততায়, আরও হাজার অসুস্থ মুখের ভিড়ে ভুলে গেছি সে বৃদ্ধের কথা। দুপুরের দিকে হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগী দেখে শেষ করেছি কেবল। একটু চা খাব বলে বের হয়েছি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মূল ফটক দিয়ে। হঠাৎ করে চমকে দিয়ে এক লোক আমাকে জড়িয়ে ধরল। ধরল তো ধরলই আর ছাড়ার নাম নেই। একসময় মুক্তি পেলাম; লোকটির দিকে তাকিয়ে দেখি এ সেই বৃদ্ধ ! এক হাত দিয়ে সে কিভাবে এতক্ষণ আমাকে এতো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখল তাই ভেবে পেলাম না। : বাজান! আমারে চিনছ? - হ্যাঁ চাচা। কেন চিনবনা? অবশ্যই চিনছি। : বাজানরে! তোমার লাইগাই আইজকা আমি বাইচা আছি। তুমি বাজান ফেরেশতার লাহান মানুষ। আল্লাহ্ তোমারে বহুত দিন বাঁচায় রাখুক, ভাল রাখুক। কথাগুলো বলতে বলতে বৃদ্ধের চোখদুটি ভিজে উঠেছে। সে তাঁর কাঁধে ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগ থেকে একটা পাকা পেঁপে বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। : বাজান! আমি এইটা তোমার লাইগা আনছি। তুমি খাইও। এবারে আমার কাঁদার পালা। আহারে! এক পঙ্গু বৃদ্ধ ভিক্ষুক আমার জন্যে তাঁর এতো কষ্টের উপার্জন দিয়ে একটা ফল কিনে এনেছে। এই আনন্দ আমি রাখবো কোথায়? রাখার জায়গা ছিলনা তাই আনন্দগুলো অশ্রু হয়ে গাল বেয়ে নেমে যেতে চাইল। রাস্তায় লোকের ভিড় লেগে যাচ্ছে, ফার্মেসির ছেলেগুলিও তাকিয়ে আছে। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বৃদ্ধকে সাথে করে ভিতরে নিয়ে এলাম। তাঁর হাত থেকে কোটি ভালবাসায় মোড়ানো একটি পাকা পেঁপে নিলাম। ওটার বিনিময়ে টাকা সেধে তাঁর আবেগকে অপমান করার দুঃসাহস হয়নি আমার। একটা রিকশা ডেকে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বৃদ্ধকে তুলে দিয়েছিলাম। আবার কাছেপিঠে কোথাও আসলে আমার সাথে অবশ্যই দেখা করে যাবে এই কথা ছিল। না, মানুষটির সাথে এরপর আমার আর দেখা হয়নি। আমিও আর সেই হাসপাতালে নেই বহুদিন। জীবনে অনেক দুঃসময় পার করেছি, অনেক অসহায় দিন কাটিয়েছি। অনেক রোগী কিংবা তাদের সঙ্গী সাথীদের অন্যায় দুর্ব্যবহার সয়েছি, নিজের পেশার উপর বীতশ্রদ্ধ হয়েছি; মেডিক্যালে জোর করে পড়ানোয় বাবা মার উপর অভিমান করেছি। সেই মুহূর্তগুলোতে হয়তো ভাগ্যকে গাল দিয়েছি, বিধাতার প্রতি রাগ দেখিয়েছি কিন্তু তার পরমুহূর্তেই মনে পড়ে গেছে সেই হাতলহীন বৃদ্ধের কথা, তাঁর মমতার কথা, তাঁর আনন্দাশ্রুর কথা। তখনই সব হতাশার মেঘ কেটে গিয়েছে এক নিমেষে। দুঃখগুলো একতুড়িতে উড়িয়ে দিয়ে ভেবেছি এক জীবনে আমি ঢের পেয়েছি। যখনই কোন বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছি মনে হয়েছে হয়তো সেই বৃদ্ধ এখনো তাঁর একটিমাত্র শীর্ণ হাত তুলে আমার জন্যে দোয়া করছেন। জানিনা কেমন আছেন তিনি। ভাল থাকুক, খুব ভাল থাকুক। যে মমতা সে আমার জন্যে দেখিয়েছিল পরম করুণাময় যেন তা আরও বহুগুণ বৃদ্ধি করে তাঁকে ফিরিয়ে দেয়... ডাঃ সাইফুল ইসলাম (dr.saiful.bd@gmail)
Posted on: Sat, 26 Oct 2013 16:09:58 +0000
Trending Topics
Recently Viewed Topics
© 2015