১৯৭২ : মোহময় মিথলজির - TopicsExpress



          

১৯৭২ : মোহময় মিথলজির সংবিধান ও বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস ১৯৭২ সালে, সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে, দুইটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল। একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল, এবং আহমদ ছফা বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস নামে একটি বই লিখেছিলেন। মাত্রাগতভাবে প্রথম ঘটনাটির গুরুত্ব দ্বিতীয়টির তুলনায় অনেক বেশি, বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু, তবুও ঘটনা দুটি পাশাপাশি উল্লিখিত হল। কেন তা পাঠান্তে স্পষ্ট হয়ে যাবে। বায়াত্তরের সংবিধানের প্রণয়ন-পদ্ধতি কি গণতান্ত্রিক ছিল? ১৯৭০ সালে পাকিস্তান গণপরিষদের জন্য নির্বাচিত পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রতিনিধিরা, যারা মূলত আওয়ামী লীগ দলের ছিলেন, তাদেরকে নিয়েই ১৯৭২ সালে গণপরিষদ গঠন করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে কী ঘটলো? প্রথমত ১৯৭১ সালটাকে হাওয়া করে দেয়া হলো। কেননা ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে একটা নির্বাচন এবং সেই নির্বাচনে অংশ নেয়া না নেয়ার বিষয়টি ছিল সেই সময়ের রাজনীতির একটা রণকৌশলগত প্রশ্ন। সেই সময়ে তৎকালীন রাজনীতির যে সমীকরণ ছিল, সেই সমীকরণ অনুযায়ী কোন কোন দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, অনেকেই অংশ নেয়নি। কিন্তু ১৯৭১ সাল ৭০ সালের ইতিহাসকে একেবারেই পাল্টে দিয়েছে। কেবল পাল্টে দেয়নি, তার মৌলিক চরিত্রকে একেবারে অন্য স্তরে নিয়ে গেছে। ৭১ সালের যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রশ্নটা ছিল অস্তিত্বের প্রশ্ন এবং জামাতের মতো রাজাকার-আলবদররা ছাড়া বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষ, রাজনৈতিক দল এই জাতীয় যুদ্ধে, এই মুক্তির লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন। সে কারণেই ৭১ সাল ৭০ সালকে মৌলিকভাবে গুণগত জায়গা থেকে পরিবর্তন করেছিল। ৭১ সালের এই পরিবর্তনকে ৭২ সালে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। কেননা ৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সমস্ত দলকে যুক্ত করার প্রয়োজন ছিল। কেবলমাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দলই নয়, জনগণের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিরা কীভাবে তাদের অভিপ্রায়ের সনদপত্র প্রণয়ন করবেন, তাদের অংশগ্রহণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন ছিল। সেটা কেবলমাত্র হতে পারত একটা সংবিধান সভা গঠনের মাধ্যমে। সংবিধান সভা নিছক কেবল পার্লামেন্ট নয়। পার্লামেন্ট সদস্যরা যেভাবে নির্বাচিত হন কিংবা তাতে যে রকম আসন বরাদ্দ থাকে, সেটা দিয়েই কেবল সংবিধান সভার নির্বাচন করা যায় না। সংবিধান সভায় জনগণের ব্যাপক অংশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য তার আলাদা কাঠামো তৈরি করতে হয়। সেই আলাদা কাঠামোর নির্বাচন করতে হয়। কিন্তু সেই কোন কাজই ৭২ সালে করা হয়নি। ৭২ সালে পাকিস্তান গণপরিষদের নির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে অধ্যাদেশ জারি করে গণপরিষদ ঘোষণা করা হয়েছে। ১৯৭১ সালে ব্যাপক জনগণের সংগ্রামের যে ইতিহাস, জামাতে ইসলামীসহ যারা বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছে তাদের বাইরে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দলের লড়াইয়ের যে ইতিহাস, তাদের অংশগ্রহণ, তাদের আত্মত্যাগ সেটা অস্বীকার করা হয়েছে। এটা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে যে কেবলমাত্র আওয়ামী লীগই হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র দল। ইতিহাসের বিকৃতি এবং তাকে দখল করা শুরু হয়েছে ১৯৭২ সালে গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে এবং যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসকে একটি দলের ইতিহাসে পরিণত করে, একজন ব্যক্তির ইতিহাসে পরিণত করে আজকে এই অবস্থায় নিয়ে আনা হয়েছে। [সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী এবং বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংবিধানের লড়াই-জোনায়েদ সাকী] বায়াত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতিঃ সুভাষিত মিথ্যাচার চার মূলনীতির যে ছেলেভোলানো মোয়া জাতিকে বায়াত্তুর সালে উপহার দেয়া হয়েছিল, আওয়ামী লীগ নিজেই তা আবার কেড়েও নিয়েছে পঞ্চদশ সংশোধনীতে। কিন্তু সেই মায়ার বাধন বামপন্থীদের বেশ বড় সড় অংশ শুধু যে ছাড়তে পারছেন না তাই নয়, তখন যারা বায়াত্তুরে সংবিধানের অন্তসারশূন্যতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, তাদের কেউ কেউ ক্লান্ত রাজনৈতিক সংগ্রামের সায়াহ্নে সেই ললিপপের শৈশবেই ফিরে যেতে চাইছেন। কিন্তু বায়াত্তুরে সংবিধানের চার মূলনীতি নিয়ে যে কোন সাধারণ পর্যালোচনায় এটা প্রতিভাত হবে যেঃ ১. এটা গণতান্ত্রিক ছিল না। বায়াত্তুরের সংবিধান কোন গণতান্ত্রিক উপায়ে রচিত হয়নি। যে গণপরিষদ সংবিধান রচনার দায়িত্ব পেয়েছিল, তাদের স্বাাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকার আইন করে শেখ মুজিবুর রহমান নিষিদ্ধ করেছিলেন। কোন ভিন্ন মত উপস্থাপন, সমর্থন বা বিরোধিতা করলে তার গণপরিষদের সদস্যপদ বাতিল হত। দুনিয়ার কোন দেশে এমনটা শুধু হয়নি তাই নয়, সকল বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দেশেই সংবিধান প্রণয়ন ও নতুন সংসদ প্রণয়ন পর্যন্ত গণপরিষদ বা সংবিধান সভা বা কনটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিই দেশ পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব পালন করে। বিরোধী দলগুলোর উল্লেখযোগ্য অংশ তো বটেই, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মানবেন্দ্র লারমার মত সংসদ সদস্যরাও সেটার অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট চরিত্র তখনই দেখিয়ে দিয়েছিলেন। অনুচ্ছেদ ৭০ এর মত দলীয় একনায়কত্ব চাপিয়ে দেয়া ধারার উপস্থিতির পরও এটাকে গণতান্ত্রিক বলাটা গণতন্ত্রের ধারণা সম্পর্কে চরম উদাসীনতার পরিচায়ক, কিংবা এমন ধরনের আনুগত্যের নিদর্শন যা জাতির সর্বনাশ করেও মিত্রকে টিকিয়ে রাখে। এই সংবিধানে কোন মৌলিক অধিকারকেই আদালতে বলবত যোগ্য করা হয়নি। প্রদত্ত সবগুলো গণতান্ত্রিক অধিকারই প্রকারন্তরে কেড়ে নেয়া হয়েছে। ৯৩ অনুচ্ছেদের অধ্যাদেশ প্রণয়নের ক্ষমতা একে বৃটিশ ভারতীয় ও পরবর্তী পাকিস্তান আমলের মতই সরকারের সংসদকে পাশ কাটিয়ে স্বেচ্ছাচারমূলক আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করেছে, এবং বিশেষ সঙ্কটের কালগুলোতে এটি নিদারুণভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। ২. এটা ধর্মনিরপেক্ষ ছিল না। বড়জোড় বলা হয়েছে যে ভিন্ন ধর্মের অনুষ্ঠানে থাকতে কাউকে বাধ্য করা যাবে না। পাকিস্তান আমলের বর্বর অর্পিত সম্পত্তি আইন বাতিল করা হয়নি। আবুল বারকাতের গবেষণাতেও পরিস্কার, সর্বাধিক পরিমান অর্পিত সম্পত্তি আওয়ামী লীগেরই দখলে আছে। ধর্মনিরপেক্ষতার হাঁকডাক যেটুকু দেয়া হয়েছিল, সেটা সম্পূর্ণভাবেই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জনগণের চেতনার যে বিকাশটি ঘটেছিল, তার সাথে একটা ছেলেভুলানো আপোষ, মাদ্রাসা শিক্ষাসহ শিক্ষা ক্ষেত্রে মৌলিক সংস্কারের কোন উদ্যোগ এই সময়টুকুতে নেয়া হয়নি। বরং তাকে জিইয়ে রাখা ও শক্তিশালী করার সকল বন্দোবস্তই ধীরে ধীরে করা হতে থাকে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত রমনা কালীবাড়ির সম্পত্তি ’৭২ সালে গণপূর্ত অধিদফতরের হাতে ন্যস্ত করা হয়, তারা বুলডোজার দিয়ে সেটি সম্পূর্ণ গুড়িয়ে দেয়। মন্দিরের ভক্তরা সুবিচারে আশায় প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করেও কোন ফল পাননি, বরং তাদেরকে বালুর মাঠে তাবুতে স্থানান্তরিত করা হয়। পরে জিয়াউর রহমানের আমলে সেখান থেকেও তাদেরকে সবলে উচ্ছেদ করা হয়। মুজিবুর রহমান আর জিয়াউর রহমানের এই দুই শাসনামলের এই দুই ধাপ আসলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভবিষ্যত নিয়তির দিকে যাত্রারই মাত্রাগত ইঙ্গিতসূচক, একজন মুক্তিযুদ্ধের অর্জনের ওপর ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে তার সাথে মৌখিক রফা করলেও রাষ্ট্রকে ক্রমাগত ভিন্ন পথে চালিত করার বন্দোবস্ত করেছেন, অপরজন সেই ভিন্ন পথে গমনের কাজটিই সুস্পষ্টভাবে সম্পন্ন করছেন। সেই অর্থে আরও বহু দিক দিয়ে পরবর্তীকালের বাংলাদেশ প্রথম পাঁচ বছরের ধারাবাহিকতাতেই পরিচালিত হয়েছে। ৩. সমাজতান্ত্রিক! শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দল এটাকে বলেছিল ‘পরিত্যক্ত সম্পত্তির সমাজতন্ত্র’ পাকিস্তানীদের ফেলে যাওয়া যে সম্পত্তি রাষ্ট্রীয়করণ হয়, সেটাকেই তারা সমাজতন্ত্র নামে চালায়। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংবিধানে স্বাক্ষর করেননি, তিনি তার বাকি সব দাবি ছেড়ে দিয়ে বলেছিলেন অন্তত বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করা হোক। সেটুকুও করা হয়নি এই ‘সমাজতান্ত্রিক সংবিধানে।’ ভূমিসংস্কার বা গ্রামাঞ্চলে ক্ষমতাসম্পর্কের ন্যূনতম কোন বদল করা হয়নি। কারখানায় পাকিস্তান আমলের চেয়ে শ্রমিকদের বেতনে মোট অংশ দশমিক অঙ্কে অতিসামান্য বৃদ্ধি পেয়েছিল। বরং অব্যাহত পরিকল্পিত দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রায়ত্তকৃত কারখানাগুলো অচিরেই অলাভজনক হয়ে পড়ে, সেগুলো জনগণের অর্থের ভর্তুকিতে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় গুটিকতক মানুষের সম্পদ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এটা সমাজতান্ত্রিক বলা অর্থহীন, গণতান্ত্রিকও এটি ছিল না। ৪. বাঙালী জাতীয়তাবাদ, এটা নিয়ে কি বলার আছে! এর মর্ম আদিবাসীরা আজও টের পান। তবে বাঙালীদের পক্ষে এটুকু বলা যেতে পারে যে, খুব দ্রুতই বাঙালী জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগ দেশটাকে ভারতীয় অর্থনৈতিক উপনিবেশে পরিনত করে, তার উত্তরসূরী জিয়া আর এরশাদ মার্কিন, চীন আর অন্যান্যদের জন্যও এই চারণভূমিটি উন্মুক্ত করে দেয়। সমাজতান্ত্রিক বা গণতান্ত্রিক হবার বিষয় বাদ যাক, এই শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় অর্থের তসরুফের বিষয়েও কতখানি শঠতার আশ্রয় নিয়েছিল সেটা বোঝা যাবে ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশে জারি করা মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক আদেশ (The Bangladesh Comptroller and Auditor-General Order, 1972 (P.O. No. 15 of 1972) আইনটির দিকে চোখ বোলালে। পৃথিবীর প্রায় সকল গণতান্ত্রিক দেশে রাষ্ট্রীয় খরচাপাতির হিসাব নিরীক্ষণ করা হয় বিরোধী দলের একজন সংসদ সদস্যের নেতৃত্বাধীন একটি কমিটির মাধ্যমে, এবং সেটি নিয়মিত ভাবে সংসদে তাদের প্রতিবেদন দাখিল করে। বাংলাদেশে প্রথম থেকে এই কমিটিকে সংসদের হাত থেকে সরিয়ে নিয়ে আমলাতন্ত্র ও নির্বাহী বিভাগের হাতে স্থাপন করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির হাতে এই কমিটির প্রধানের নিয়োগ প্রদানের ক্ষমতা ন্যাস্ত করে এই গুরুত্বপূর্ণ পদটির দলীয়করণ ও নিরাপদকরণ সম্পন্ন করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, একটি কমিটি হিসেবেও এটি প্রথম থেকে আজও অকার্যকর। এটা করাই হয়েছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও অর্থের যে বিপুল তসরুফের ওপর এই শাসকগোষ্ঠী প্রথম থেকে দাঁড়িয়েছিল, তাকে আড়াল করার জন্য। এই সংবিধানের বলেই বিদেশের সাথে সম্পাদিত অধিকাংশ চুক্তি গোপন থেকে যায়, জনগণের সামনে প্রকাশ করা দূরে থাকুক, জনপ্রতিনিধিদের সামনেও আলোচনার দরকার পড়ে না। কিন্তু বায়াত্তুরের সংবিধানে ফেরত যাওয়ার কথা বলে আজকে যে আর কোথাও যাওয়া যাবে না, সেটা আন্দোলনকারী দল/শক্তি/সংগঠনসমূহ উপলদ্ধি করে না, তা নয়। এদের দেশপ্রেম ও ব্যক্তিগত সততাও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সন্দেহের উর্ধে। কিন্তু বায়াত্তুরের সংবিধানে ফেরত যাবার অর্থে তারা আসলে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সরকার যে মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষা ও চেতনার সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করলো, সেই ইতিহাসটি হয় অতীত রাজনীতির ধারাবাহিকতার কারণে আড়াল করছেন কিংবা নতুন করে ইতিহাসের আওয়ামী ব্যাখ্যার বলয়ে হাজিরা দিচ্ছেন। [শাসনতন্ত্রের সংকট: উপনিবেশের জের, ইতিহাসের দায়-ফিরোজ আহমেদ] বায়াত্তরের সংবিধানঃ লুটেরা নব্যধনীদের সমাজতান্ত্রিক(?) ইশতেহার !!! ১৯৭২ সাল থেকেই বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ সদ্যজাত বাংলাদেশকে কিভাবে ভারতের প্রায় অর্থনৈতিক উপনিবেশে পরিনত করা হচ্ছে, তার নিয়মিত বর্ণনা ও প্রতিবাদ জারি রাখলেও ভারতের রাজনৈতিক প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ নিয়েও তারা সঙ্গতকারণেই উদ্বেগ প্রকাশ করছিলেন। বলা যায়, বাংলাদেশের শৈশবাবস্থাতেই যে নিয়ন্ত্রণমূলক অর্থনৈতিক সম্পর্ক ভারতের সাথে স্থাপিত হয়েছিল, তারই সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যবস্থাও দেশে জারি হয়েছিল। এই অধীনতামূলক অর্থনৈতিক সম্পর্কের জন্যই প্রয়োজন ছিল স্বৈরতান্ত্রিক, গোপনপ্রবণ এবং জনগণের অংশগ্রহণহীন একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থা।রেহমান সোবহানের মত আওয়ামীপন্থী অর্থনীতিবিদের রচনাতেও নতুন শাসক হয়ে ওঠা বাঙালী পেটিবুর্জোয়া শ্রেণীর লুণ্ঠনের চিত্র পাওয়া যাবে (যদিও বায়াত্তুরের সংবিধানের জাতীয় আন্তর্জাতিক দেশীয় শিল্পকারখানা ও উৎপাদন ক্ষেত্রে শাসক শ্রেনীর বেপরোয়া লুণ্ঠনের সাথে ভারতের সাথে এই পরনির্ভরশীল অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার সম্পর্কটি তার রচনায় কখনোই আসেনি।) রেহমান সোবহান এবং আরও অনেকের বিবেচনায় আওয়ামী লীগ মূলত ছিল উৎপাদনের সাথে সম্পর্কহীন ক্ষুদে বুর্জোয়াদের রাজনৈতিক দল, স্বাধীনতার পর এরা রাষ্ট্রক্ষমতার প্রধান ব্যবহার করেছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির বৃদ্ধিতে, এর বাইরে ধনী হবার প্রধান উপায় ছিল রিলিফ সামগ্রী লুণ্ঠন (দেশের দ্বিতীয় ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হওয়া যুবলীগ নেতা গাজী গোলাম মোস্তফা ছিলেন রেডক্রসের চেয়ারম্যান), লাইসেন্স পারমিটের একচেটিয়াকরণ এবং গ্রাম ও মফস্বলে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষসহ অপরের সম্পত্তি দখল। কারখানাগুলোতে সরাসরি কলকব্জা পাচার থেকে শুরু করে বাড়তি মূল্যে যন্ত্রপাতি-কাঁচামাল সরবরাহ, অস্বাভাবিক কম দরে উৎপাদিত দ্রব্যাদির একচেটিয়া সরবরাহের অধিকার লাভ এবং সেই পণ্যাদি অস্বাভাবিক উচ্চদরে জনগণের কাছে বিক্রিএই ছিল সম্পত্তি মালিক হবার সবচে’ লাভজনক উপায়। রেহমান সোবহান তার ‘রাষ্ট্রায়ত্ত্ব খাতের উদ্বৃত্ত আয়ের বন্টন ব্যবস্থা: বাংলাদেশের অভিজ্ঞতার আলোকে’ নিবন্ধে দেখিয়েছেন ৬৯-৭০ সালে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে উৎপাদন মূল্যের বন্টনে শ্রমিক কর্মচারিদের বেতন ছিল ১০.৫০ ভাগ, বস্তুগত উপাদান বাবদ খরচ ছিল ৫৬.২০ ভাগ। স্বাধীনতার পর ৭৫-৭৬ সালের মাঝে শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন বাবদ অংশ বৃদ্ধি পায় মাত্র দশমিক ৪০ ভাগ, কিন্তু উৎপাদন সামগ্রী বাবদ খরচ ১২.২০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৬৮.৪০ ভাগে। উল্লেখ্য করা দরকার যে, পাকিস্তান আমলেও এই কারখানাগুলোতে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি বেশি পাবার উদ্দেশ্যে এই বস্তুগত উপাদান খাতে খরচ এমনিতেই বহু বেশি ধরা হতো, সেটিই বাংলাদেশ আমলে আরও বৃদ্ধি পাওয়া লুণ্ঠনের মাত্রা বৃদ্ধিরই ইঙ্গিত করে। রেহমান সোবহারের ওই নিবন্ধে খুচরা পর্যায়ে বিক্রির বেলায় মুনাফার হারের যে সংবাদ দেয়া হয়েছে, তা আরও ভীতিকর: “এ থেকে দেখা যায় যে এ ধরণের পণ্যের ফ্যাক্টরি মূল্য থেকে উচ্চতর খুচরা মূল্যের ব্যবধানের সীমা ৮০ শতাংশ থেকে ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত ওঠানামা করে থাকে।” ওই একই নিবন্ধের সাত সংখ্যক সারণীতে পাওয়া যাবে ৭৩-৭৪ সালে সার, সাবান, ওষুধ, চিনি, সিমেন্ট, পাট, ময়দা সমেত ২৫টি রাষ্ট্রীয় খাতে উৎপাদিত পণ্যের তালিকা, যেগুলোর অধিকাংশতেই উৎপাদন খরচের (কাঁচামাল ক্রয়ে দুর্নীতির ফলে যা ইতিমধ্যেই কৃত্রিম ভাবে বৃদ্ধি পাপ্ত) চেয়ে ক্ষেত্রবিশেষে অতি কম, সামান্য কম বা সমান দরে কারখানার বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন যে চিনির উৎপাদন খরচ ৪০৪ টাকা, কারখানাগেটে বিক্রয়মূল্য ২৪৫.২ টাকা! রেহমান সোবহানের হিসেবে চিনির বাজারজাত করণে ’৭৪-’৭৫ সালে মুনাফা হত ১০০-১৫০ ভাগ। সাবান উৎপাদনের বেলায়ও উৎপাদন খরচ ৭১.৫, কারখানা গেটে বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ৭০.৭, বাজারজাতকরণে মুনাফার হার ছিল ১২১ ভাগ। দু’টি পণ্যেরই দাম নির্ধারণ করেছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এভাবে কারখানা পর্যায়ে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দাম নির্ধারণ করাটা চক্রান্তমূলক ছিল নাকি পারমিটধারীদের মুনাফা যথাসম্ভব উচ্চ করার ‘নিরীহ ধান্ধা’, তা বলা মুশকিল। কিন্তু এর ফলাফল যা হবার তাই হল। এভাবে কৃষক পর্যায়ে চাষীরা কতটা বঞ্চিত হতো, এবং পরিশেষে দেশবাসী কত টাকায় পণ্যটি ক্রয় করতো এবং ‘সমাজতান্ত্রিক’ বাংলাদেশে মধ্যস্বত্তভোগীরা ধাপে ধাপে জনগণের কতটা অর্থ পকেটস্থ করতো, তার একটা ধ্রুপদী উদাহরণ পাওয়া যাবে ১৯৭৪ সালের লবণ কেলেঙ্কারির সময়ে। ৯ অক্টোবর দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত শ্রমিক লীগের এমপি আবদুল মান্নান এর বক্তব্য অনুযায়ী “লবণের দুষ্প্রাপ্যতা সম্পর্কে সম্ভাব্য সকল প্রকার খোঁজ নিয়ে জানা গেছে যে, মজুতদার উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে ২ টাকা মন দরে লবণ কেনে। মজুতদারদের জন্য অশোধিত লবণের সরকারী দাম ১৫ টাকা, আর শোধিত লবণের দাম ৫৫ টাকা।...অশোধিত লবণের দাম ৪০ টাকা করা হলে বাজারে প্রচুর লবণ পাওয়া যাবে মজুতদারের মত প্রকাশ করছেন।” লবণের দাম এই সময়ে খুচরা পর্যায়ে কত ছিল, সেটা কল্পনাতীত নিশ্চয়ই, এই বক্তব্যের কয়েক মাস আগেই পত্রিকার খবর অনুযায়ী চার আনা সেরের লবণের দাম ৩২ টাকা হয়ে গিয়েছিল। চাষী যেটি মন প্রতি দুই টাকা দরে বিক্রি করছেন, অতি সামান্য মূল্য সংযোজন শেষে সের প্রতি তা ৩২ টাকায় খুচরো বিক্রি হওয়া থেকেই কতটা অকল্পনীয় হারে লুণ্ঠন সম্পন্ন হয়েছে তা বোঝা যায়। পরিকল্পনা কমিশনের হিসেব থেকে জানা যায় মাত্র দুই বছরে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম প্রায় চারশ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছিল। বর্ধিত এই গোটা অর্থ অল্প কিছু রাজনৈতিক যোগাযোগসম্পন্ন পারটিমটধারী ব্যক্তির পকেটস্থ হত। এর পুরোটাই ‘সমাজতান্ত্রিক’ বাংলাদেশের নব্য ধনীক শ্রেণীর পকেটস্থ হয়ে কেবল তাদের সম্পদই বৃদ্ধি করেনি, দেশের উৎপাদন ক্ষেত্রেরও মহাসর্বনাশ করেছিল। দেশে পরিচালিত এই আদিম কায়দার সম্পদ আহরণের একটা সঙ্গত পরিনতি ছিল দেশীয় শিল্প-কৃষি কাঠামোর সম্পূর্ণ বিনষ্টি, তার বিকাশ রহিত হওয়া এবং পরনির্ভরশীলতার অর্থনীতির জন্ম। লুণ্ঠনের অপর পিঠটি তাই ছিল প্রথমত এবং প্রধানত ভারত, এবং এর সাথে বাকি পুঁজিবাদী দুনিয়ার একটি অধীনস্ত রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতি-রাজনীতির বিকাশ। [শাসনতন্ত্রের সংকট: উপনিবেশের জের, ইতিহাসের দায়-ফিরোজ আহমেদ] বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাসের বায়াত্তর ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিজয় দিবসে, সংবিধান কার্যকর হয়। সেই ডিসেম্বর মাসের ৫ তারিখে আহমদ ছফার বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল। এই বইয়ে সরাসরি বায়াত্তরের সংবিধান নিয়ে যে কোনো কথা থাকবে না তা দিনতারিখ দেখে সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু ছফার বইয়ে কিছু ইশারা আছে। সমসময়কে ধারণ করতে পারা লেখকের লেখায় অদূর ভবিষ্যতের ইশারা থাকে, যেমন ১৯০৭ সালে মা লিখে গোর্কী জানান দিয়েছিলেন যে শুভ ঝড়ের আগমনের, তা রাশিয়ায় এসে পড়েছিল বছর দশেকের মধ্যেই (রুশ বিপ্লব-১৯১৭) ছফা ছিলেন তেমনি একজন লেখক। তাই বায়াত্তরের সংবিধান সংক্রান্ত এই লেখায় ছফাকে টেনে আনলাম।ছফার বই থেকে টানা কয়টা কোটেশন দেইঃ আমাদের সমাজ এখন একটি দোলাচলের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। জনগণ সত্যি সত্যি গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জন করতে পারে এবং সমাজের প্রাচীন সম্পদ সম্পর্ক ভেঙে দিয়ে সমাজে অধিকাংশের কল্যাণমুখী শোষণহীন নয়া ধন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আবার একটি বিশেষ শ্রেণী গালভরা চটকদার শ্লোগানে জনগণকে বিভ্রান্ত করে ক্ষমতায় গ্যাঁট হয়ে বসে পাকিস্তানি একনায়কদের অনুকরণে চিন্তার স্বাধীনতা, জীবিকার স্বাধীনতা, কল্পনার স্বাধীনতা, এককথায় দেশের নামে, জাতির নামে সমস্ত মানবিক স্বাধীনতা হরণ করতে পারে। ইতিহাসে এমন ঘটনা অনেক ঘটেছে। ঘটনাচক্রে বাংলাদেশেও যদি তেমন ঘটে যায়, খুব বেশি অবাক বা বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। বর্তমান সরকার গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি ঘোষণা করেছেন। এসবকে সংস্কৃতি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার জন্য যে সকল মানুষ ভাড়া করে এনেছেন তাঁদের অতীত জীবনের রচনা পাঠ করে বলে দেওয়া যায়, এঁদের বুদ্ধি একনায়কের সেবা ছাড়া আর কোন কিছুতেই খেলে না। সরকার দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলছেন, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন কিন্তু কিভাবে? শিক্ষা ও সংস্কৃতি তো সমাজ সৃজনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। সেই শিক্ষা ও সংস্কৃতির রূপায়নের জন্য যে সকল মানুষ আমদানি করছেন, তাঁদের বেশিরভাগই তো আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানের প্রিয় অফিসার। এঁদের দিয়ে সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা ও সংস্কৃতি সৃজন-কামারকে দিয়ে সোনার গয়না গড়ানোর মতই অবাস্তব। আমার মনে হয়, বায়াত্তরের সংবিধান জিনিশটা আসলে কি ছিল তা আমরা কিছুটা হলেও বুঝতে পারলাম। যাঁরা কষ্ট করে পড়েছেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ। [গণসংহতি পত্রিকা কর্তৃক প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধে জনগণের আকাঙ্ক্ষা এবং গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রতিষ্ঠার লড়াই জোনায়েদ সাকী ও ফিরোজ আহমেদের লেখার কোটেশনগুলি নেওয়া হয়েছে। খান ব্রাদার্স এণ্ড কোম্পানি কর্তৃক প্রকাশিত আহমদ ছফার সাম্প্রতিক বিবেচনাঃ বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস বই থেকে ছফার লেখার কোটেশনগুলো নিয়েছি।]
Posted on: Sat, 02 Nov 2013 11:01:41 +0000

Trending Topics



Recently Viewed Topics




© 2015