পর্ব-৩৫ আকাঙ্খিত জামিন, - TopicsExpress



          

পর্ব-৩৫ আকাঙ্খিত জামিন, অনাকাঙ্খিত বিচ্ছেদ! ফজরের নামাজের পরে হালকার উপর ঝাপসা একটু বিছানায় গড়িয়ে নেয়া অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, ৩১ডিসেম্বরও ব্যাতিক্রম ছিলোনা, প্রচন্ড ঠান্ডায় কম্বল মুড়ি দিয়ে ছিলাম। এরই মধ্যে ৭নম্বর ওয়ার্ড হতে ঘোশকের দ্রুত কন্ঠের জামিন ঘোশণা ভেসে আসলো, “এই জামিন শুনেন! এ মোঃ হানিফ পিতাঃ ননা মিয়া, থানা কোতওয়ালী জামিন.........!” সবাই জানে হানিফ ভাই আমার কেসপার্টনার, একই মামলার একাধিক আসামীদের কেসপার্টনার বলা হয়। হানিফ ভাইয়ের জামিন হয়েছে মানে আমারও জামিন হয়েছে, কিছুক্ষণ পরেই ঘোশক আমার ওয়ার্ডে আসবে এবং আমার জামিন ঘোষণা করবে, এটা নিশ্চিত। হই হই করে উঠলো এতোদিনের সঙ্গী-সাথীরা, যাদের সাথে কাটিয়েছি প্রায় দু’টি মাস! যে জামিনের জন্য এতোদিনের হাহাকার, যে জামিনের জন্য এত প্রচেস্টা, যে জামিনের জন্য এতো দৌড়ঝাপ, প্রতীক্ষা। আজকে সে জামিন আসছে শুনেই বুকের ভেতরটা কেমন যেনো শূণ্য হয়ে গেলো, চোখের সামনে ভেসে উঠলো হাসান মুরাদের সহজ সরল চোখে থই থই জল কিংবা ইব্রাহীমের করুণ চাহনী। মনযোগী মাহবুবের মনদিয়ে জেল খাটা, ভার্সিটিতে ভর্তি হতে না পারার বিষণ্ণ স্মৃতি! মনে পড়ছিলো ইব্রাহীমের সে জিজ্ঞাসা, শামীম ভাই আপনার জামিন হয়ে গেছে, আপনিতো যে কোনো দিন চলে যাবেন, আমরা এখানে একা কিভাবে থাকবো? কম্বল মুড়ি দিয়েই আশাপাশের হই চই শুনছিলাম, চোখের সামনে ভাসছিলো বিগত ৫১দিনের স্মৃতি। লুৎফর ভাই এক টানে মুখের উপর হতে কম্বল তুলে নিলেন, ওয়ার্ডের সকল আসামী আমার চারপাশে ভিড় করেছে, খুশিতে ঝলমল করছে সকলের মুখ! বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছিলোনা, বার বার তাকাচ্ছিলাম সংগঠনের ভাইদের মুখের দিকে, তারাও দেখলাম খুশিতে ফেটে পড়েছে, বিদায় যে কতটা আনন্দের হতে পারে, এদের মুখের দিকে না তাকালে সেটা কারও পক্ষে অনুভব করা অসম্ভব! পাশের ওয়ার্ডের জামিন ঘোষণা শেষ হতেই ঘোশক আমার ওয়ার্ডে চলে আসলো, একের পর এক নাম ঘোষণা করেই যাচ্ছে, এরপরে এলো আমার নাম। নাম ঘোশণা শেষ করে ঘোশক জিজ্ঞাসা করলো ভাই খুশির খবর দিলাম কি দিবেন? হেসে জিজ্ঞাসা করলাম আপনি কি চান বলেন, দেয়ার চেস্টা করবো? তিনি বললেন আপনি খুশি হয়ে যা দিবেন তাই নিবো! জেলখানাতেতো এক প্যাকেট সিগারেট দিলেই সবাই খুশি হয়, একপ্যাকেট সিগারেটেই তিনি খুশি হয়ে চলে গেলেন! জানতাম যেকোনো দিন জামিন হয়ে যাবে, কিন্তু আজকেইযে সেইদিন সেটা জানা ছিলোনা, সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবেই অন্যরকম একটি ভোর নিয়ে আবির্ভুত হলো দিনটি। কারাগারে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় যেটা দেখেছি, জামিন ঘোষণার খুশিতে জামিনপ্রাপ্ত ব্যাক্তি যখন সকলের সাথে কোলাকুলিতে ব্যস্ত, ঠিক সেই মূহুর্তেই কতিপয় লোক ব্যস্ত থাকে তার জিনিসপত্র চুরি করার কাজে। জুতা স্যান্ডেল হতে শুরু করে কিছুই বাকি থাকেনা। আমার ব্যাগ আগেই গুছিয়ে রেখেছিলাম এবং সবাইকে এটাও জানিয়ে দিয়েছি, আমি চলে যাওয়ার সময় কিছুই সাথে নিবোনা, ব্যাগের জিনিসপত্র সংগঠনের ভাইয়েরা ব্যবহার করবে। বিপুল সংখ্যক আসামী পরিণত হয়েছিলো বিপুল সংখ্যক শুভান্যুধায়ী-বন্ধুতে। লুৎফর ভাই, কাদের ভাই, খানে আলম, চেয়ারম্যান জসিম, বিধান দা, তারেক, মোর্শেদ, সালাউদ্দীন, দেলাওয়ার, একে একে সবার কাছ হতেই বিদায় নিলাম, রসু খাঁ দেখলাম ঘুমিয়ে আছে তাই জাগালামনা। বিদায়ের সময় দেলাওয়ারের সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বললাম, বিগত দিনগুলোতে সংগঠন সম্পর্কে দেলাওয়ার একটা পজেটিভ ধারনা অর্জন করেছিলো, দেলাওয়ার কমিটমেন্ট দিলো বের হয়ে ছাত্রশিবিরের সাথে সম্পৃক্ত হবে। সংগঠনের ভাইদের মধ্যে হাসান মুরাদ, ইব্রাহীম, মাহবুব এবং দুইজন জামায়াত সমর্থক ছিলেন সাঈদ ভাই এবং শহীদ ভাই, (তারা অন্য একটি সন্দেহজনক মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন)। কর্ণফুলী-৪এ ছিলেন বদিউর রহমান ভাই এবং ইউসুফ ভাই (ইউসুফ ভাই আমার সাথে একই দিন গ্রেপ্তার হলেও ভিন্ন থানার ভিন্ন মামলা হওয়ায় জামিন হতে টাইম বেশি লাগছিলো)। দীর্ঘদিনের কারাজীবনের সঙ্গী এই ভাইদের কারাগারের চারদেয়ালের অভ্যন্তরেই ফেলে যেতে হচ্ছে! বিচ্ছেদের এই অনুভুতি, মনের ভেতরকার তোলপাড়, হৃদয় ভাঙার এই গান ভাষায় ব্যাক্ত করা অসম্ভব। সদ্য জামিনপ্রাপ্ত ব্যক্তির বিদায় বেলায় অধিকাংশ আসামী তাকে একটা জিনিসই দিতে চায় সেটা হচ্ছে ফোন নম্বর! প্রিয়জনের কাছে সংক্ষেপে একটি তথ্য জানিয়ে দেয়ার অনুরোধ! এই অনুরোধের মূল্য এবং মর্জাদা মুক্ত স্বাধীন ব্যক্তি কখনো উপলব্ধি করতে পারবে বলে মনে হয়না। পঞ্চাশটিরও বেশি ফোন নম্বর এবং প্রতিটি নম্বরের নিচে সংক্ষেপে একটু লেখা, কেউ লিখেছে আমি ভালো আছি, চিন্তা করবেনা, আবার কেউ প্রিয়জনকে দেখা করার অনুরোধ করেছে, কেউবা অনুরোধ করেছে মামলার সর্বশেষ অবস্থার তথ্য নিয়ে যেনো তার সাথে দেখা করা হয়। চেয়ারম্যান জসিম ভাই অনুরোধ করলেন, ওয়ার্ডের মুসল্লিদের জন্য কিছু টুপি এবং তসবী কিনে পাঠানোর জন্য। ঝাড়া হাতপায়েই ওয়ার্ড হতে বেরিয়ে এলাম, ভবনের সামনের হাউজে তখনো একদল আসামী ঠেলাঠেলি করে গোসল করছে, প্লেটে প্লেটে ঠোকাঠুকির শব্দ হচ্ছে, হলুদ থক থকে আয়রণ যুক্ত সে পানির কথা ভোলার নয়। আজকে আর গোসল করলামনা, এখান হতে বেরিয়ে গোসল করবো ইনশাআল্লাহ্‌! সংগঠনের ভাইয়েরা কর্ণফুলী ওয়ার্ডের সামনের মূল গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলো। কনডেম সেলের সামনে দিয়ে আসার সময় বার বার ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিলাম যদি আলমগীর ভাই-কিংবা আজম ভাইকে একটু বিদায় জানাতে পারতাম! যদি বিদায় বেলায় একনজর তাদের সাক্ষাৎ পেতাম! কিন্তু সব ইচ্ছেতো আর পূরণ হয়না! বদি ভাইকে বলে এসেছিলাম, তাদের কাছে সালাম পৌছে দিতে। কনডেম সেলের খাবার সরবরাহের দায়ীত্বে নিয়োজিত কয়েদী সুমনের সাথেও দেখা হয়ে গেলো, তাকে বলে দিলাম আমার জামিনের সংবাদটা ভেতরে পৌছে দিতে। চলবে............
Posted on: Sun, 25 Aug 2013 09:43:29 +0000

Trending Topics



Recently Viewed Topics




© 2015