গদ্য কার্টুনঃ গোল মাথার - TopicsExpress



          

গদ্য কার্টুনঃ গোল মাথার গণ্ডগোল……? দক্ষিণ আমেরিকার মহাদেশের একটা দেশ কলাম্বিয়া। সেখানকার এক খুব বিখ্যাত লেখক, গল্পকার গ্যাব্রিয়েল মারক্যুয়েজ। ১৯৮২ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তার একটা উদ্ধৃতি দিয়ে আজকের লেখালেখি আরম্ভ করছি। তিনি বলেছিলেন, কোন কিছুর সমাপ্তির জন্য দুঃখ করো না.........বরং ঘটনা ঘটে যাবার জন্যে আনন্দিত হও (Dont Cry because it is over... Smile because it happened.”)। পৃথিবীর যারা মহা পণ্ডিত মানুষ, তাদের মূল্যবান কথা আমরা আমাদের জীবনে ব্যাবহার করি। সন্তানদের বলি তাদের চরিত্র গঠনে উদ্বুদ্ধ করতে, নিজেদের দুঃসময়ে নিজেকে শুনিয়ে শক্তি সঞ্চয় করি, এবং পরিশেষে নিজেদের কর্মকাণ্ডের তার কতটুকু প্রভাব ছিল তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। তাদের এই কথা গুলোকে আমরা শুদ্ধ বাংলা ভাষায় বলি উদ্ধৃতি কিংবা ইংলিশে quote। যাই হোক, আজকে একটু পরীক্ষা করে দেখলে কেমন হয়, এই সব জগত জোড়া উদ্ধৃতি আমাদের বাঙ্গালী রাজনৈতিক নেতাদের ব্যাখ্যা করতে পারছে কি-না। তবে প্রিয় পাঠক, আপনি কিন্তু অবশ্যই মনে রাখবেন, আমরা অন্য জাতিদের থেকে বিভিন্ন দিক থেকে স্বতন্ত্র। অন্য দেশী পণ্ডিতরা যা ভেবে গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতার বাণী লিপিবদ্ধ করে গেছেন, তা আমাদেরকে ব্যাপারে একে বারে অন্যভাবেও প্রযোজ্য হতে পারে। চলুন আমরা আরম্ভ করি। ফ্রান্সিস পিকাবিয়া (১৯২৭-১৯৮৯) ফরাসী দেশের একজন বিখ্যাত অঙ্কন শিল্পী যিনি দাদা আর সুররিয়ালিস্ট আর্ট আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। তার ছিল ছবি আর কবিতা বিচিত্র ভাবে প্রকাশনার অদ্ভুত ক্ষমতা। তিনি মানুষের মস্তিষ্কের শক্তি সম্পর্কে খুব বিশাল-ভাবে ভাবতেন। তিনি বলেছিলেন, আমাদের মাথা গোল হওয়ার কারণ হল যাতে আমাদের চিন্তাধারা তার চলার দিক পরিবর্তন করতে পারে। এইটা আমরা, আমাদের দেশে, বেশ দেখতে পাই। নির্বাচনের আগে এক কথা, পরে আরেক আচরণ। নেতারা খুব সুন্দরভাবে তাদের গোল মাথাটাকে ব্যাবহার করে ফেলেন। বিমান যেখানে উঠা নামা করে, তাকে আমরা বিমান বন্দর বলি। প্রথমে রাজধানীর সেই বিমান বন্দরের নাম পরিবর্তিত হয়ে গেল। তার পরে ঠিক করা হল, দূরের একটা বিল ঝিলের জায়গায় সেই বিমানবন্দরকে পাঠিয়ে দিতে হবে। আরম্ভ হয়ে গেল আন্দোলন। না, গোল মাথা থেকে নতুন সিদ্ধান্ত আসলো, না এইটা করা হবে না। যাই হোক, এক দিককার কথা বললে, অন্য পক্ষ বলবে পক্ষপাতিত্ব চলছে। অন্য দলের এক নেত্রী স্থানীয় নেতার মাথা থেকে আসলো, সারা দেশে খাল কাটলে দেশের সব সমস্যা মিটে যাবে। প্রতিদিন সরকারী টেলিভিশনে আমলা, কামলা থেকে সবাইকে দেখা গেল খাল কাটা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। এলাকায় নদী থাকুক কিংবা না-থাকুক, খাল কাটা চলতে লাগলো। অবশ্য ঠিক বুঝা গেল না, খাল কেটে কুমির ডেকে আনার ব্যবস্থা করা হল, না-কি রাজাকারদের পুনর্বাসন করা হল। এক পর্যায়ে নেতার মনে হল, দেশের সব সমস্যার শেষ এমনিতেই হয়ে যাবে। এখন বিদেশীদের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে। আরম্ভ হল বিদেশ ভ্রমণ। হঠাত আরেক গোল মাথায় আসলো, বিদেশ ভ্রমণে সুন্দর চেহারার মানুষ থাকলে, সৌন্দর্য বেড়ে হয় শতগুণ। ব্যাস আরম্ভ হয়ে গেল, সুন্দর চেহারার নায়ক-নায়িকাদের ভ্রমণ সঙ্গী করে নেয়া। কিছু বছর আগে যারা সরকারে ছিলেন না; এমন সব নেতাদের মাথা থেকে আসলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দেশে অবাধ নির্বাচন হতে পারে না। যেই চিন্তা সেই কাজ। আন্দোলন করে সেই দাবী আদায় করে ছাড়া হল। পরবর্তীতে সেই চিন্তাশীল নেতাদের এক দল ক্ষমতায় এসে দেখলেন গোল মাথা তাদের চিন্তা ধারা অন্য রকম করে দিয়েছে। তারা বললেন, এই ব্যবস্থা সংবিধান বিরোধী। এই বার এমিলি ডিকিনসনের (১৮৩০-১৮৮৬) কথায় যাই। তিনি মার্কিন দেশের এক নামজাদা মহিলা কবি ছিলেন। আমাদের মূল নেতা দুজন মহিলা হওয়াতে তার কথা ফলে যাবার সম্ভাবনা অনেক। তিনি বলেছিলেন: Fame is a bee ( খ্যাতি এক মৌ মাছি) It has a song ( তার একটা গান আছে) It has a sting ( তার একটা হুল আছে) Ah too, it has a wing ( আহ, সাথে আবার পাখাও আছে) কথাগুলোর ব্যাখ্যার নিশ্চয়ই দরকার পড়ে না। আপনার নিজেরাই এই লাইনগুলোর সাথে মিলিয়ে নেতাদের অনেক কিছু খুঁজে পাবেন। একজন নেত্রী তার এক সময়কার সংগ্রামী বান্ধবীকে তার স্বামীর সরকারী বাসা থেকে উচ্ছেদ করে বললেন, নন গ্র্যাজুয়েট অশিক্ষিত পরিবার। আবার, সেই ঘর থেকে উচ্ছেদকৃত নেত্রী, যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন তার সাজ প্রসাধন, দেশে বিদেশে আলোচিত হত। তবে এমন বলা হচ্ছে না, এখন সে জিনিষটা নিয়ে আর কথা হয় না। অনেকটা না চাইতেই তারা খ্যাতির মৌমাছি হতে পেরেছেন। নিজের অজান্তেই তাদের গুন-গানের জলসা মাহফিলের আয়োজন করে চলেছেন। তার সাথে যে হুলটা চলে এসেছে, তা প্রতিপক্ষকে ফুটাতে খুব বেশী সময় নেন না। আর হা হা হা হা, তাদের তো পাখাও আছে। সবাই নিশ্চয়ই এর মধ্যে জেনে ফেলেছেন, তাদের অবস্থান চিল পাখিদের থেকেও উপরে। এই বার ব্রিটিশদের খুব পরিচিত ও বিখ্যাত একটা কৌশল বলি। Divide and Rule ভাঙ্গ এবং শাসন কর। এই বিশাল ভারত উপমহাদেশকে, তারা হাতে গোনা কিছু ব্রিটিশ মানুষদের দিয়ে শাসন-শোষণ করত। তাদের রাজত্ব চালানোর মূল মন্ত্র ছিল, সব কিছু ভেঙ্গে সবার বিরুদ্ধে সবাইকে লাগিয়ে দেয়া। হিন্দুর বিরুদ্ধে মুসলমান, উচ্চ গোত্রের বিরুদ্ধে নিম্ন গোত্র আরও কত কি। বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশ সে শত বছরের পুরাতন ব্রিটিশ কৌশল খুব পরিষ্কার ভাবে নতুন করে এসেছে। যে কেও, সামান্য চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন। এক দলের মানুষ অন্য দলের মানুষকে মাথা ফাটিয়ে খুন করেও শান্ত হতে পারছে না। তার পরে দরকার হচ্ছে জ্বালাতে, পোড়াতে। এক বাঙালি জাতি আজ শত ভাগে বিভক্ত। মাননীয় পাঠক, আপনি কি বুঝলেন, কেন বাঙালি এত ভাগে বিভক্ত? আমাদের শাসকরা কি ব্রিটিশ, না –কি পাকিস্তানি, নাকি আমাদের মত বাঙ্গালী। তারা কি ব্রিটিশদের কৌশল খাটানোর ব্যাপারে ব্রিটিশদের থেকেও সফল? আমাদের নেতাদের যে যাই বলুক; তারা কিন্তু জ্ঞানে বুদ্ধিতে আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে থাকেন। সেই জন্যেই তো, তারা আমাদের নেতা। তারা মহা পণ্ডিতরা কে কি বলে গেছেন, তা ঠিকই খুঁজে বের করছেন আর সেই হিসাবে কাজ করছেন। অতি চমৎকার ফলাফল পাচ্ছেন। সুখেই আছেন তারা। শুধু পাবলিক অস্থির হয়ে দিশেহারা হচ্ছে। হা-হুতাশ করছে, মাথা ফাটা ফাটি করে প্রাণ দিচ্ছে। যদি কোন পাঠক প্রশ্ন করেন, পৃথিবীর সব দেশের সব নেতাই একই জ্ঞান দিয়ে একই ভাবে প্রয়োগ করছেন কিনা।? অবশ্যই এর ব্যতিক্রম আছে। ঘটনাক্রমে বলি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬ তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের একটা উদ্ধৃতি । তার অনেক বড় বড় অবদান আছে। তিনি দাস প্রথা বাতিল করেছিলেন। তিনি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, তুমি যদি কৃতিত্ব কে পেল সেই চিন্তা মাথায় না আন, তা হলে আশ্চর্য সব কর্ম সাধন করতে পার। ( it’s surprising how much you can accomplish, if you don’t care who gets the credit).কিন্তু আমাদের নেতারা ব্যাপারটা এখানে একেবারে অন্যরকম, কাজটা হল কি-না, সেটা একেবারেই গৌণ; কৃতিত্ব নেতাদের থাকতেই হবে। এর এক চুল ব্যাতিক্রম হতে পারবে না। অবশ্য আরেক দিক দিয়ে আমরা খুবই সৌভাগ্যবান। আমাদের নেতারা, মন্ত্রীরা কে কি করেছেন, সেটা জানার জন্যে আমাদের কোন কষ্ট করতে হয় না। তারা নিজের ঢোল নিজেরাই পেটাতে ব্যস্ত থাকেন। এতই ব্যস্ত থাকেন যে; অনেক সময় নিজের কাজ করার সময় বের করা মহা কষ্টকর একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সাথে সাথে বিরোধীদের নেতিবাচক বিশেষণে ভূষিত করার আরেকটা জাতীয় দায়িত্বও তারা পালন করে থাকেন। তারা এই দিক দিকে আব্রাহাম লিঙ্কনের কথায় খুব একটা ভরসা রাখতে পারেন না। কৃতিত্বকে সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে কেও চেষ্টার কোন ত্রুটি করেন না। কাজ হোক বা না হোক, তাদের কাছে কৃতিত্বটাই আসল ব্যাপার। সর্বশেষে গ্যাব্রিয়েল মারক্যুয়েজের যেই কথা দিয়ে লেখাটা আরম্ভ করেছিলাম, সেটা আবার মনে করিয়ে দেই: Dont Cry because it is over... Smile because it happened.”। বাঙালি অনেক কেঁদেছে; প্রতিটা ঘটনা, প্রতিটা আঘাত, প্রতিটা দুর্যোগের পরে। এখন বাঙ্গালী আর কাঁদে না। বাঙ্গালি হাসে। এই হাসিতে দুটো উচ্চারণ, এক, আঘাতটা শেষ হল আর আমরা বুঝলাম আঘাতটা কেমন হতে পারে। দুই, এই হাসি আনন্দের হাসি না। কান্নার জল শুকানোর পর এই হাসির জন্ম হয়েছে। এই হাসি প্রতিবাদের, এই হাসি সব বঞ্চনা আর শোষণ বন্ধ করার সশব্দ হুঙ্কার।
Posted on: Fri, 05 Sep 2014 04:54:06 +0000

Trending Topics



Recently Viewed Topics




© 2015